
ছবি: ড. আলেয়া পারভীন
অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন প্রভৃতি শব্দগুলো পৃথিবীজুড়ে কয়েক দশক ধরে বেশ জোড়ালোভাবেই আলোচিত হচ্ছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে প্রায় সকল ক্ষেত্রে এখনও নারী বা কন্যারা পশ্চাদ্পদ। তাদের অনগ্রসরতা বা পশ্চাদ্পদতা দূর করে তার প্রাপ্যতা পুরুষের সমপর্যায়ের করার লক্ষ্যে বেগম রোকেয়ার দুই চাকা তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ এখনও আবশ্যক।
এক চাকা দিয়ে সাইকেলের গতিশীলতা যেমন অত্যন্ত দূরহ, তেমনি সমাজের গতিশীলতাও ক্রমান্বয়ে শ্লথ হয়ে পড়ে। কাজেই যে কোন বাস্তবতায় আজকের দিনেও নারীর অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
অধিকার, সমতা, ক্ষমতা প্রভৃতি শব্দগুলো সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবেই জড়িত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অধিকার বলতে মানুষের অত্যাবশ্যকীয় মৌলিক সুযোগ-সুবিধাকে বোঝায় যা সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত। অধ্যাপক লাস্কির মতে, প্রত্যেক রাষ্ট্রই পরিচিত হয় তার প্রদত্ত অধিকার দ্বারা। কাজেই মানুষ হিসেবে একজন নারী সমাজ বা রাষ্ট্রে কতটুকু অধিকার ভোগ করে তার ওপর সমাজ বা রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ণীত হয়।
সাধারণত যখন বলা হয় ‘সকল মানুষ সমান’ তখন নারীও আবশ্যিকভাবে এর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে নারী পুরুষের অনুরূপ আচরণ পাবার এবং অধিকার ভোগের দাবিদার যা অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত। তাই সমতা বলতে এমন এক অবস্থাকে বোঝায় যেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সকল মানুষ সমান সুযোগ-সুবিধা, সমান অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করে। আরো বিশ্লেষণাত্বকভাবে বললে, নারী-পুরুষ সাম্য বলতে বুঝায়, নারী ও পুরুষের ভিন্নরূপ আচরণ, আকাক্সক্ষা এবং চাহিদাগুলি সমভাবে বিবেচিত হবে, মূল্যায়িত হবে এবং সহায়তা পাবে ।
ক্ষমতায়ন হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা ব্যক্তি সকল প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। এক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন বলতে বুঝায় মানুষ হিসেবে নারীর সকল ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করে অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের সকল স্তরে তথা পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে পুরুষের ন্যায় নারীর কার্যকরী অংশগ্রহণ ও অধিকার নিশ্চিতকরণ। মানবিক উন্নয়নের লক্ষ্যই হচ্ছে মানুষ তথা নারীর ক্ষমতায়ন। তবে অধিকার, সমতা, ক্ষমতা প্রভৃতি শব্দগুলো দ্বারা নারী বা কন্যাদের উন্নয়ন তথা মর্যাদা রক্ষিত হচ্ছে কিনা তা আলোচনার দাবী রাখে। কেননা এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “কেবল ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না।” আরও বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র গণজীবনের সর্বস্তরে নারীগণ পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবে। কিন্ত বাস্তবতা এই যে মানুষের জীবন বিশেষ করে পারিবারিক জীবন কেবল সাংবিধানিক আইন নয়, পারিবারিক আইন দ্বারাও নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে সাংবিধানিক ও পারিবারিক আইন দ্বারা মানুষ হিসেবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান সুযোগ সুবিধা, সমান অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করে কিনা, সচেতন নাগরিক হিসেবে তা সবার জানা জরুরি। আমরা জানি যে পারিবারিক আইন তৈরি করা হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে। যেমন ইসলাম ধর্মের উপর ভিত্তি করে তৈরী হয়েছে মুসলিম পারিবারিক আইন, হিন্দু ধর্মের উপর ভিত্তি করে তৈরী হয়েছে হিন্দু পারিবারিক আইন এবং এভাবে অন্যান্য আইন পারিবারিক আইন। দেখা যায়, সাংবিধানিকভাবে নারীদের আইনগত সমতা নিশ্চিত কিন্ত পারিবারিক আইনে রয়েছে এর ব্যতিক্রম। সকল ধর্মের পারিবারিক আইনে এক ধরনের বৈষম্য বিরাজমান থাকায় নারীদের আইনগত সমতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৫০ সাল থেকেই ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোডের বিষয়টি আলোচনায় আসে কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোডের ধারণা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। কাজেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীর সমতা, অধিকার কিংবা ক্ষমতায়ন বিষয়ে আলোচনা করতে হলে এর সামাজিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা যাবেনা। ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন পরবর্তীসমাজে এ বাস্তবতা বিবেচনা করা আরো বেশি জরুরি। কেননা সমাজের একটি শ্রেণি অধিকার বা সমতার নামে যাচ্ছে তাই করে বেড়াচ্ছে যা মূলত নারী অধিকার বা সমতার মূল স্পিরিটকে নষ্ট করছে। পাশাপাশি আরেকটি শ্রেণি উগ্রতা বা কট্টরতার মাধ্যমে নারীর অধিকার, সমতা বা ক্ষমতায়ন চর্চার বিষয়গুলোকে জোড় করে বন্ধ করতে চাইছে।
প্রকৃতপক্ষে, অতি আধুনিকতা বা অতি উগ্রতা উভয়ই নারী আধিকার বা সমতা প্রতিষ্ঠার অন্তরায়। সম্প্রতি ঢাকার মোহাম্মদপুরে দুই ছাত্রীর ধুমপানকে কেন্দ্র করে যে ঘটনার সূত্রপাত এবং পরবর্তীতে তাদের নিগৃহীত হওয়ার বিষয়টি যে পর্যায়ে পৌঁেছ তা অত্যন্ত অমর্যাদাকর গোটা নারী বা মানবসমাজের জন্য। প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে নারীর এই ধুমপান নারী-পুরুষ সমতার নির্দেশ করে না। কেননা সমতা হল এমন এক অবস্থা যেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সকল মানুষ সমান সুযোগ-সুবিধা, সমান অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করে যা ন্যায়সঙ্গত। যা কিছু ক্ষতিকারক তা কি ন্যায়সঙ্গত ? আইনকে তোয়াক্কা না করে আমাদের দেশের পুরুষেরা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে ধুমপান করে চলেছে অন্যায়ভাবে। তাদেরকে দেখে এখনকার তরুনীদের অনেকেই উৎসাহিত হয়ে সমানাধিকারের নামে ধুমপান করছে। কিন্তু পুরুষের ন্যায় নারীর ধুমপান করা কোনো অধিকার বা সমতার বিষয় নয়। এটি পুুরুষেরই করা অন্যায় ও বদ অভ্যাসের নারী প্রতিচ্ছবি।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের একজন কর্মচারি কর্তৃক একই বিশ^বিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীকে হুট করে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বাজে মস্তব্য (ড্রেস ঠিক নাই, পর্দা করে নাই) করে হেনস্থা করা হয় এবং ওই কর্মচারির কর্মকান্ডকে সমর্থন করে একটি বিশেষ গোষ্ঠী। নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্থা করার বিষয়টি স্বীকার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই কর্মচারি অত্যন্ত আপত্তিকর ভাষায় তা আবার বর্ণনা করেন। এখন প্রশ্ন হলো একজন নারী কি পোশাক পড়বে তা কি অন্য কেউ নির্ধারণ করে দিতে পারেন? কে পর্দা করবে আর কে পর্দা করবে না সেটাও নারীর ব্যক্তিগত বিষয়। যে নারী হিজাব পড়তে চায় তাকে যেমন সে বিষয়ে বাধা দেয়া যায়না তেমনি যে নারী হিজাব পড়তে চায় না তাকেও বাধ্য করা যায় না। পোশাকের স্বাধীনতা সকলেরই সমান। বিষয়টি আসলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির। একজন পুরুষ নারীকে কিভাবে দেখেন বা মূল্যায়ন করেন? মানুষ হিসেবে নাকি কেবলই মেয়েমানুষ হিসেবে? কেবল মেয়েমানুষ হিসেবে দেখলে নারীর মেধা ও দক্ষতার পরিবর্তে শরীরিক যোগ্যতার বিষয়টি প্রাধান্য পায়। ফলে সমাজে নারী পর্দা করে নাই বলে ইভ টিজের মত ঘটনা ঘটে, বহুবিবাহের ঘটনা ঘটে, এমনকি ধর্ষণের মত ঘটনাও ঘটে। সাম্প্রতিক কালে মাগুরায় ঘটা ৮ বছরের শিশু আছিয়া ধর্ষণ যে কিনা এখনও নারী হয়ে ওঠেনি, তা কেবল মেয়েমানুষ বলেই ঘটেছে। এক্ষেত্রে বয়স কোন বিবেচ্য বিষয় নয়, বিবেচ্য হল মেয়েমানুষের শরীর। তাইতো দেখা যায়, যে কোন বয়সের নারীরাই অহরহ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নারীর প্রতি সহিংস আচরণে বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ। সরকারি হিসেবেই ৭২% নারী তাদের ঘনিষ্ঠজন কর্তৃক শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার। নিপোর্ট এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৬০% স্বামী তাদের স্ত্রীদের নির্যাতন করে। ৯৬% নারী গণপরিবহণে যৌন হয়রানির শিকার হন। আর এসকল ঘটনা অব্যাহত থাকা প্রমান করে অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায় নারীর হীন অবস্থা।
প্রশ্ন হচ্ছে অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায় কন্যা ও নারীর অবস্থা ও অবস্থান নামমাত্র কেন। এর কারন হিসেবে পুরুষতন্ত্রকে চিহ্নিত করা যায়। পুরুষতন্ত্র শব্দটি সমাজ-রাষ্ট্রের সকল পরিসরে পুরুষের আধিপত্য এবং নারীর ওপর ফলানো কর্তৃত্বসূচক সম্পর্ককে প্রকাশ করে। এটি এমন এক ব্যবস্থা যেখানে পুরুষ নারীকে নিয়ন্ত্রন ও অবমূল্যায়ন করে এবং তা স্বাভাবিক হিসেবেই দেখা হয়। পুরুষতন্ত্রের বিধি অনুযায়ী সামাজিক মনস্তত্ত্ব এমনভাবে গড়ে উঠেছে যেখানে একই কাজ করে অর্থাৎ ধূমপান করে নারী পাচ্ছে তিরস্কার সেখানে পুরুষের ধূমপান করা নিয়ে কেউ প্রশ্নই তুলছে না, শাস্তি তো দূরের কথা।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সামাজিকায়ন প্রক্রিয়ায় নারীকে সর্বক্ষেত্রে অধস্তন এবং পুরুষকে প্রাধান্য বিস্তারকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করায় আর্থিক ও রাষ্ট্রিক প্রতিষ্ঠানে তৈরি হয়েছে নানাবিধ পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ। পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধকে আরো মজবুত করে তোলে কিছু সামাজিক রীতি-নীতি, কুসংস্কার ও ধর্মীয় অপব্যাখ্যা। যার ফলে দেখা যায় অর্থ আয় করেও ব্যয়ে নেই নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধিকার। নারীর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার বারংবার হোঁচট খায়। কাজেই আন্দোলনে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকলেও নিরাপত্তাহীনতার কারণে ক্ষমতা চর্চার সর্বোচ্চ স্তর রাজনীতিতেও দেখা যায় নারী নেতৃত্বের স্বল্প উপস্থিতি। তবে ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে সমতাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার যে অভিপ্রায় লক্ষ্য করা গেছে তাতে রয়েছে অসংখ্য নারীর স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব। আর এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সফলতার অন্যতম কারিগর নারীদের অসংখ্য উপস্থিতি। কিন্তু আন্দোলনপরবর্তী সময়ে বিভিন্ন নেতিবাচক মতাদর্শ প্রচার করে, প্রভাব খাটিয়ে নারীকে অধিকারহীনতা বা সমতাহীন করার অপচেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। কাজেই অপচেষ্টাগুলো চিহ্নিত করে তা সমূলে উৎপাটন করতে পারলে নতুন বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রেই পুরুষের পাশাপাশি নারী ও কন্যার অধিকার, সমতা এবং ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠা পাবে বলে আশা করা যায়।
সহযোগী অধ্যাপক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান)
সরকারি সংগীত কলেজ, ঢাকা।
//এল//