ঢাকা, বাংলাদেশ

বুধবার, , ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

English

মতামত

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ও টেকসই কর্মসংস্থান

মো. খালিদ হাসান:

প্রকাশিত: ১২:২২, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ২০:২৯, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ও টেকসই কর্মসংস্থান

সংগৃহীত ছবি

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বের অন্যতম জনবহুল একটি উচ্চশিক্ষা কাঠামো। ৫৫টি পাবলিক ও ১১৫টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৪৫ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে যা অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। তবে এই বিশাল উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারা আমাদের দেশের অন্যতম বড়ো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিভিন্ন গবেষণা ও প্রতিবেদন থেকে উঠে আসা তথ্য আমাদের এই খাতের বিদ্যমান সমস্যাগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরছে। এই বিশাল শিক্ষার্থী সংখ্যার সাথে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি, কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষতা ও জ্ঞান বাড়ানোর দিকেও জোর দেওয়া প্রয়োজন।


২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ৫০ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪১ লাখ ৩১ হাজার ৬১০ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। অন্যদিকে ১০৮ টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বমোট শিক্ষার্থী ৩ লাখ ১০ হাজার ১০৭ জন। শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েই ২৯ লাখ ৩৪ হাজার ৭১২ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে যা দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলিত শিক্ষার্থীর সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ।

এই সংখ্যা উচ্চশিক্ষার প্রসারকে একটি গর্বের বিষয় হিসেবে তুলে ধরলেও এর গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে বড়ো ধরনের পার্থক্য রয়েছে। 


শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক বণ্টনও বেশ বৈচিত্র্যময়। কলা ও মানবিক বিভাগে সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থী থাকলেও, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত (এসটিইএম) বিষয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। অন্যদিকে, ব্যবসায় শিক্ষা ও সামাজিক বিজ্ঞানের চাহিদা বাড়ছে। তবে, এই বিষয়গুলোতে অর্জিত শিক্ষার সঙ্গে শ্রম বাজারের চাহিদার মিল কতটুকু, তা ভাবনার বিষয়। এ অবস্থায়, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের প্রতি গুরুত্ব বাড়ানো উচিত।


২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, তখন দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৮২ হাজার। এই বেকারদের মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আছেন ৭ লাখ ৯৯ হাজার। এর মানে হলো মোট বেকারের প্রতি তিন জনে একজন উচ্চশিক্ষিত। ঢাকা ভিত্তিক সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ (সিডিইআর)-এর বাংলাদেশ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড লেবার মার্কেট ওয়াচ ২০১৬ প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ক্রমবর্ধমান। ২০১০ সালে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০১৩ সালে বেড়ে  ১৬ দশমিক ৪ শতাংশে পৌঁছায়। যদিও ২০১৬ সালে তা কিছুটা কমে ১২ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসে, তবুও উচ্চশিক্ষিত তরুণদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বেকার রয়ে গেছে।

কর্মসংস্থানের এই চিত্র আমাদের শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে দুর্বলতা নির্দেশ করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে শিক্ষারব্যবস্থা করা হয়েছে, তা প্রায়ই চাকরির বাজারের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ফলে, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মী না পেয়ে বিদেশি কর্মী নিয়োগ করতে বাধ্য হয়। ২০১৮ সালে সংসদে উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশি কর্মরত, যাদের প্রায় অর্ধেকই ভারতীয়। এই পরিসংখ্যান দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 


বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতের বিভিন্ন স্তরে বিদেশি কর্মীদের উপস্থিতি আমাদের কর্মসংস্থান নীতিমালার দুর্বলতাকে ইঙ্গিত করে। তৈরি পোশাক খাত, ওষুধ শিল্প, এবং অন্যান্য উৎপাদন খাতে মধ্য-স্তরের ব্যবস্থাপনা এবং কারিগরি দক্ষতার ঘাটতির কারণে বিদেশি কর্মীদের আনতে হচ্ছে। বিশেষত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রযুক্তিগত ও পেশাগত দক্ষতার অভাব বাংলাদেশের তরুণদের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তাকে জোরালো করে।

বিদেশি কর্মীদের প্রাধান্য শুধু প্রযুক্তি এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; অনেক ক্ষেত্রে তারা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) পণ্য উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়েও ভূমিকা রাখছে। এটি দেশের মেধাসম্পদ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। দেশের তরুণ প্রজন্মকে এই ক্ষেত্রে দক্ষ করে তোলা অত্যন্ত জরুরি।


উচ্চশিক্ষার প্রসারের পেছনে পরিকল্পনার অভাব স্পষ্ট। দেশে শিক্ষা পরিকল্পনার চারটি মূল পদ্ধতি রয়েছে। বাংলাদেশে মূলত সামাজিক চাহিদা পদ্ধতির ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। এটি উচ্চশিক্ষার আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করলেও কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ। অন্যদিকে, জনশক্তি পরিকল্পনা পদ্ধতির মাধ্যমে শ্রম বাজারের চাহিদা অনুযায়ী  শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তোলা সম্ভব। দুর্ভাগ্যবশত, এই পদ্ধতির অভাব আমাদের শিক্ষাকে কর্মসংস্থানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারছে না। এ অবস্থায় একটি সুসমন্বিত শিক্ষা পরিকল্পনার প্রয়োজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


উন্নত দেশগুলোতে উচ্চশিক্ষা একটি শক্তিশালী গবেষণা ও উদ্ভাবন নির্ভর কাঠামোর ওপর গড়ে  উঠেছে। যেমন, জার্মানি এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো তাদের শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনমুখী শিক্ষা প্রদান করে। এসব দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিল্পের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে কারিকুলাম তৈরি করে। এই মডেলগুলো বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার জন্য কার্যকর উদাহরণ হতে পারে। বাংলাদেশ এই তুলনায় পিছিয়ে আছে। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা ও উদ্ভাবনে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে পারছে না। ফলে, আমাদের স্নাতকরা আন্তর্জাতিক চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা ও উদ্ভাবনের প্রসারে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।


শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণার পরিবেশ এবং গুণগত শিক্ষাদানের অভাব বিদ্যমান। অনেক ক্ষেত্রেই পাঠক্রম ও শিক্ষাদানের পদ্ধতি যুগোপযোগী নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিল্পের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী  কোর্স এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা হয় না। শিক্ষার্থীদের বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়টি অবহেলিত। চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা করার জন্য প্রযুক্তিগত এবং পেশাগত দক্ষতার প্রয়োজন, যা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের শিক্ষার্থীদের নেই। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় না। এই শিক্ষার মাধ্যমে সরাসরি কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের অভাব রয়েছে। গবেষণায় অগ্রগতি মানসম্মত উচ্চশিক্ষার মূল ভিত্তি। উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা স্নাতকদের উদ্যোক্তা হতে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যর্থ। উদ্যোক্তা তৈরি হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও বাড়বে।


বর্তমান শিক্ষাক্রমকে আধুনিক চাকরির বাজারের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে পুনর্গঠন করা জরুরি। বিশেষত এসটিইএম বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ানো এবং দক্ষতা উন্নয়নে জোর দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণ ও ইন্টার্নশিপ নিশ্চিত করতে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করা উচিত। কর্মসংস্থানের জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করতে বৃত্তিমূলক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা জরুরি। উচ্চশিক্ষায় গবেষণার মান উন্নয়নে আরও তহবিল বরাদ্দ করতে হবে। গবেষণার ফলাফল শিল্প এবং উৎপাদন খাতে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভব। দেশীয় দক্ষ জনশক্তি গড়ে  তুলে বিদেশি কর্মীদের উপর নির্ভরতা কমানো সম্ভব। তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে  তুলতে প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা প্রদান করা দরকার। 

     শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যুগোপযোগী শিক্ষাদানের জন্য তাদের আধুনিক প্রযুক্তি এবং শিক্ষা কৌশলে দক্ষ হতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্য অর্জনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে পারদর্শী করে গড়ে  তোলা জরুরি।

সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষার সুযোগ প্রসার করতে বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া উচিত। এর মধ্যে টিউশন ফি মওকুফ, বৃত্তি প্রদান, এবং বিনামূল্যে শিক্ষাসামগ্রী সরবরাহ অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কেবল প্রযুক্তিগত বা কারিগরি দক্ষতা নয়, শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধেও শিক্ষিত করা প্রয়োজন, যাতে তারা সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। এই ধরনের উদ্যোগগুলো পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন করা হলে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়ন অনেক দ্রুত গতিতে সম্ভব হবে। 


বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। শিক্ষার প্রসার ঘটলেও মান এবং দক্ষতার অভাবে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব বাড়ছে। শিক্ষার সঙ্গে শিল্পখাতের চাহিদার অসামঞ্জস্য দূর করা এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। উচ্চশিক্ষার কাঠামোতে গুণগত পরিবর্তন এনে আমরা একটি দক্ষ, প্রতিযোগিতামুলক এবং টেকসই অর্থনীতি গড়ে  তুলতে পারব। 

লেখক: সহকারী তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর, ঢাকা 
পিআইডি ফিচার 

 

//এল//

সরিষাবাড়ীত বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল

২০ লক্ষ টাকা জিতে নেওয়ার সুযোগ

বানারীপাড়ায় মাসব্যাপি সূর্যমণি মেলা শুরু

১৩ হাজার কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ

আগরতলা মিশনে বুধবার থেকে ভিসা সেবা চালু করবে বাংলাদেশ

আগরতলা মিশনে ভিসা সেবা চালু হচ্ছে বুধবার

ইজতেমায় দ্বিতীয় ধাপে ২৩ যুগলের যৌতুকবিহীন বিয়ে

২০ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা

‘গত কয়েকদিন হত্যা ও ধর্ষণের অসংখ্য হুমকি পেয়েছি’

রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় চিন্ময় দাসকে জামিন দিতে হাইকোর্টের রুল

সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ৮ ফেব্রুয়ারি

ঝিকরগাছায় নারীকে বেঁধে রেখে মারপিট, জড়িতদের শাস্তি দাবি

নোয়াখালীতে শিশু ধর্ষণে চেষ্টার অভিযোগে যুবক গ্রেপ্তার

পোষ্য কোটা ইস্যুতে উত্তাল জাবি

পাসপোর্টে থাকছে না পুলিশ ভেরিফিকেশন