ছবি: এএইচএম নোমান
সুষ্ঠু নির্বাচন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অন্তবর্তীকালীন সরকার ইতিমধ্যে দুই দফায় ১০টি কমিশন গঠন করেছে। এরমধ্যে ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নির্বাচন নিয়ে কাজ করা দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ড. বদিউল আলম মজুমদার।
জনমালিকানা ভিত্তিক ও অন্তর্ভূক্তিমূলক একটি সার্বজনীন নির্বাচন ব্যবস্থাপনা স্থাপন করতে দরকার একটি সামগ্রিক সহায়ক ব্যবস্থাপনা ।
এয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে বিচারপতি যুবায়ের চৌধুরীর নেতৃত্বে সার্চ কমিটি গঠন করেছেন। তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। পুনর্গঠিত ইসি ভোটার তালিকা হালনাগাদসহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যাবতীয় প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। এরি মধ্যেই নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু হয়ে গেছে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
পাশাপাশি সকল দলের আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার চিন্তা ভাবনা নিয়ে দেশের সংস্কার কাজ এগিয়ে যাচ্ছে আশা করা যায়। বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট যে, জুলাই -আগষ্ট ২০২৪ এর ছাত্র জনতার সফল আন্দোলন, প্রশ্ন-বিতর্ক, সংঘাত-অরাজকতা, অস্থিরতা, ধবংসাত্মক পরিস্থিতির বিপরীতে, সকলের গ্রহণীয়তা, জবাবদিহিতা ও শান্তিকামিতাই পারবে প্রকৃত গণতন্ত্রের নির্বিঘ্নে চলার পথে অর্থনৈতিক মুক্তির বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে। পরিস্থিতির শঙ্কা- সমস্যার একমাত্র সমাধান হতে পারে সকলের কাছে গ্রহণীয় একটি ব্যবস্থা ও কার্যকর পদ্ধতি। এজন্য ‘সার্বজনীন নির্বাচন ব্যবস্থাপনা পরিষদ’- সানিবপ গঠনের প্রস্তাবনা রাখছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ভোটারদের স্বাধীন ইচ্ছায় গণতান্ত্রিক সরকার গঠন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে এই পরিষদ সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে। আমরা গভীরভাবে বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক দলই দেশ পরিচালনা করবে ও ক্ষমতায় আসীন হবে। অপরপক্ষে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। এভাবেই এদেশে গণতন্ত্র শেকড় পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত কাঙ্খিত জনকল্যাণমূলক ফল দিতে পারবে। শান্তির জন্য কেবল ধৈর্য, পরমতসহিষ্ণুতা ও পরস্পর আদর্শিক শ্রদ্ধাবোধ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করবে।
কাঠামো ও গঠন প্রণালী :
১. নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধিত ও নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলের প্রতিনিধি সমন্বয় ও সমঝোতায় আলোচনার মাধ্যমে তাদের মধ্য হতে নিবাচিত হবেন।
২. একজন সমন্বয়ক ও একজন যুগ্ম সমন্বয়ক সানিবপ এর দায়িত্ব পালন করবেন। দলের অনুমোদনে জোটভুক্ত দলের সভাপতি/চেয়ার বদল হতে পারে। ৩. নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট পর্যায়ের কর্মকর্তা সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। ৪. নির্বাচন কমিশন তালিকাভুক্ত নির্বাচনে দেশীয়-এলাকা পর্যবেক্ষণ সংস্থা/এনজিও প্রতিনিধি, যুগ্ম সচিব হবেন। আলোচনা সাপেক্ষে কাঠামো হতে পারে।
১. এই পরিষদের কাঠামো হবে ৫ স্তর বিশিষ্ট ক. জাতীয় খ. জেলা গ. আসন/উপজেলা ঘ. ইউনিয়ন, ঙ. ভোট কেন্দ্র। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্ট ধাপের কর্মকর্তা, সুশীল সমাজ, শিক্ষক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমন্বয়কারী, গণমাধ্যম প্রতিনিধি, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও এনজিও প্রতিনিধি এ পরিষদের সদস্য হবেন।
২. নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক রাজনৈতিক দল থেকে ৩ জন করে প্রতিনিধি থাকবেন। তাঁরা হলেন সংশ্লিষ্ট পর্যায়ের রাজনৈতিক দলেরঃ সভাপতি/চেয়ারপার্সন, সেক্রেটারি ও সাংগঠনিক সম্পাদক।
সেখানে থাকবে প্রতিদ্বন্দ্বী ৫টি দলে ৩ জন = ১৫ জন কমিটির ব্যবস্থাপনায়
ক. ইউনিয়ন, খ. নির্বাচনী এলাকা/উপজেলা, গ. জেলা এবং ঘ. জাতীয়-এ চার পর্যায়েই সাচিবিক ধাপ/শাখার দায়িত্ব পালন করবেন।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনা পরিষদ -থাকবে মূল ফ্রেমে :
প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়া, নির্বাচন কমিশন ঘোষিত এবং গ্রহণীয় ফ্রেম অনুযায়ী হবে। এ পরিষদ নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ, স্বাধীন, স্বচ্ছ, শক্তিশালী ও গতিশীলতায় সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। এটি রাজনৈতিক দল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠন, এনজিও নেটওয়ার্কসহ সুশাসন বিনির্মাণে গণতন্ত্র চর্চ্চা ও ব্যবহারিকতা আনয়নে সহায়ক হবে।
সার্বজনীন নির্বাচন ব্যবস্থাপনা পরিষদ গঠন ও মেয়াদকাল :
জাতীয় নির্বাচনকে সুষ্ঠু, গ্রহণীয় ও সার্বজনীনভাবে কার্যকর করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন, সকল রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, ছাত্র প্রতিনিধি, আগ্রহী ব্যক্তি, জোট ও পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধি সমন্বয়ে এ পরিষদ গঠন করবে। এ পরিষদ নির্বাচনকালে প্রার্থী প্রাক-মনোনয়ন, প্রচারণা, নির্বাচন পরিচালন অর্থাৎ নির্বাচন শুরু ও ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের সহায়ক (বাফার সংগঠন) দায়িত্ব পালন করবে।
নির্বাচন শুরু ও ফলাফল প্রক্রিয়া পর্যন্ত দল-বেদল, মত ও পন্থা অনুযায়ী কারা কোথায়, কী ধরনের অবস্থান ও কার্যক্রম নিবেন তা রাজনৈতিক দল ও প্রতিনিধি অর্থাৎ এই পরিষদ একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমে থেকে নীতিগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।
পরিষদের মেয়াদকাল হবে নির্বাচন বছরে বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন থেকে পূর্বের ৬-৯ মাস ও পরবর্তী ৩ মাস অর্থাৎ মোট ৯ থেকে ১২ মাস। এই পরিষদ শুধু নির্বাচন ফলাফলসহ সমাধান পর্যন্ত একটা নীতিগত নিরপেক্ষ ফ্রেমে থাকবে।
মনোনয়ন কাঠামো :
নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়া নির্বাচনী এলাকায়ই প্রায় সমাপ্ত হবে। জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের বা যত আসন সিদ্ধান্ত হয় - মনোনয়ন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নির্বাচন ফলাফল পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে সহায়ক শক্তি হিসেবে এ পরিষদ কাজ করবে।
প্রার্থী মনোনয়ন কে ঠিক করবে ও কিভাবে করবে :
স্থানীয় রাজনৈতিক দল বা নির্বাচক মন্ডলীর প্রস্তাবে ও সমর্থনে প্রতি নির্বচনী এলাকায় গঠিত দলীয় কমিটি প্রার্থী মনোনয়ন/প্রস্তাব করবে। সানিবপ সংসদ এলাকার প্রতিটি ইউনিয়নে দু’বারে ২টি জনসভা করবে। প্রথমটি অবহিতকরণ ও প্রস্তুতি সভা। ইউনিয়ন পরিষদ অঙ্গন বা উদ্যোক্তাদের আলোচনাক্রমে যে কোনো খোলা জনসমাগমস্থল হতে পারে। উভয় সভার জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে মাইক, চোঙ্গা, ঢোল, সহরত বা স্থানীয় যে কোনো বা সাধ্যমত সকল প্রকার প্রচারণা ব্যবস্থায় স্থানীয় জনগণের সমর্থনে মনোনয়ন প্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকাভুক্ত করা। সকল ইউনিয়নে জনসভা শেষে উপজেলা পরিষদ/সংসদ এলাকা পর্যায়ে বৃহৎ জনসভা করা। এর মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে দলীয়ভাবে প্রস্তুত নামের তালিকা ঘোষণা করা।
সংশ্লিষ্ট সানিবপ তার এলাকা থেকে প্রাপ্ত তালিকার সকল প্রার্থীর অংশগ্রহণে ‘ছাকুনি-ঝাকুনি’র মাধ্যমে নির্বাচনী এলাকার প্রার্থী তালিকা তৈরি করা। সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলওয়ারী বাছাই চূড়ান্ত করে মনোনয়নের জন্য জেলা কমিটির মাধ্যমে জাতীয় কমিটির কাছে সুপারিশ করা। এ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা পরিষদ দলীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া।
নির্বাচনী প্রচারণা :
নির্বাচন কমিশন নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি গ্রাম, পাড়া, ইউনিয়ন, জনসমাগমস্থল, বাজার পুরো এলাকা মিলে ২০-২৫টি সভা হবে। একই মঞ্চে সকল প্রার্থী যার যার নির্বাচনী ওয়াদা, দলীয় আদর্শ ও ইস্তেহারসহ বক্তব্য দিবেন।
নির্বাচনী ফান্ড-ব্যয়-ব্যবস্থাপনা:
কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন কমিশন সরাসরি বা দলকে নির্বাচনী ফান্ড দিতে পারে অথবা প্রতিটি আসনে নির্বাচনী কার্য পরিচালনার জন্য প্রতি প্রার্থী তাদের নির্বাচনী নির্দিষ্ট বাজেট থেকে ২০-২৫ লক্ষ টাকা আসন/উপজেলা সানিবপ তহবিলে প্রদান করবে। নির্বাচনী ব্যয় কমালে নির্বাচন সহনীয় হবে। ফলে কালো টাকার প্রার্থীদের দাপট কমবে। সৎ, সজ্জন ও যোগ্য প্রার্থীদের পক্ষে মনোনয়ন পাওয়া সহজ হবে। এখন নির্বাচনী ব্যয়ের অজুহাতে অনেক সৎ ও সজ্জন ব্যক্তিকে রাজনৈতিক দল মনোনয়ন দিচ্ছে না। মোটা দাগে বলা যায়, প্রতি আসনে সাকুল্যে এক থেকে দেড় কোটি টাকা বাজেটে ব্যবস্থাপনা ব্যয় সংকুলান হবে। প্রার্থী ও আসন বাস্তবতায় কম বেশী হতে পারে। তাহলেই বৈষম্যহীন স্বনির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণ হবে। ছাত্র জনতার শোষনহীন সমাজ ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে জুলাই -আগষ্ট ২০২৪ বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে গণতন্ত্রের স্বাদ ও সুফল দেশবাসী সমভাবে ভোগ করবে। রাজনৈতিক/দলীয় সরকার, অন্তবর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা যে নামেই হোক না কেন প্রস্তাবিত এ সানিবপ ‘বাফার’ সংগঠন হয়ে কাজ করবে। তা হলেই স্থায়ীভাবে স্বাধীন মুক্ত নতুন বাংলাদেশে দুর্নীতিমুক্ত আদর্শিক রাজনীতির জন্য স্থায়ীভাবে সকলের কাছে গ্রহণীয় ‘সার্বজনীন নির্বাচন ব্যবস্থাপনা পরিষদ’ কার্যকর হবে।
সবশেষে বলা যেতে পারে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সকলের কাছে গ্রহণীয় করতে, সানিপব গঠনের মাধ্যমে আদর্শিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি সৃষ্টি করা। তাই এখন থেকেই নির্বাচন কমিশন/নির্বাচন সংস্কার কমিশন বা অন্তবর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে ওয়ার্কিং পেপার দিয়ে সংলাপের মাধ্যমে সানিপব গঠন ও কার্যকারিতা আরম্ভের আহবান জানানো জরুরি । প্রস্তাবিত সানিপব নির্বাচন কমিশনের ছাতা ও ব্যবস্থাপনার সমন্বয় করবে। নির্বাচন ব্যবস্থা, পদ্ধতি বা সংস্কারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সকলকে বিশেষ করে দেশবাসীর প্রত্যাশার আশ্রয়স্থল নির্বাচন কমিশন বা অন্তবর্তীকালীন সরকার বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনকে উদ্যোগী ভূমিকা পালনের আহবান জানাই।
লেখক পরিচিতি : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ-বামাসপ এবং সদস্য ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ-
//এল//