ছবি: মো. মাহমুদ হাসান
মনে পড়ে কাঞ্চন আর দিপালী সাহার কথা? স্বৈরশাসকের বুলেট যাঁদের বুকের পাঁজর ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল! সেলিম, দেলোয়ার, রাউফুন বসুনিয়ার কথা কি ভুলে গেছেন? স্বৈরাচারের ট্রাকের চাপায় পৃষ্ট হয়ে নির্মম নিষ্ঠুরভাবে যাঁরা শহীদ হয়েছিল! নূর হোসেন তো ইতিহাস। তাঁর কথাও ভুলে গেছেন? বুকে পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’ হাসতে হাসতে যে ছেলেটি জীবন দিয়েছিল। মেধাবী চিকিৎসক ডাক্তার মিলনের লুটিয়ে পড়া নিথর দেহটির স্বকরুন দৃশ্যটি কি আপনাদের চোখে ভাসে না? আর যাঁরা ষাট ছুঁই ছুঁই, তাঁরা নিশ্চয় ভুলে যাননি, আপনাদের চার বছরের ডিগ্রিটি নিতে, আট বছর সময় লেগেছিল। জীবন থেকে মূল্যবান চারটি বছরকে হারাতে হয়েছিল? কি স্বপ্ন, কি জাদু,কি মন্ত্র, কি আরাধ্য অনুপ্রেরণা কাজ করেছিল, সেসব অমূল্য সব ত্যাগের পেছনে?
বসুনিয়া স্বপ্ন দেখেছিল গণতন্ত্রের বাংলাদেশ হবে। দিপালী সাহার কল্পনায় ছিল সাম্যের সমাজ। সেলিম, দেলোয়ার শোষণ মুক্ত, দুর্নীতি আর দুঃশাসন বিবর্জিত একটি সমাজের স্বপ্নে বিভোর ছিলো। নূর হোসেন ভেবেছিল, গণতন্ত্রেই মুক্তি। স্বৈরশাসকের বিদায়ে লাখো জনতার উচ্ছ্বাসে রাজপথ কেঁপে উঠেছিল। এত মৃত্যুর পরও, বাদ্যে, বাদ্যে আর সংগীতের মূর্ছনায় ভবিষ্যৎ সুখী বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে আনন্দ উত্তেজনায় নেচে উঠেছিল তরুণ সমাজ। ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসলো। গণতন্ত্রের ধারা উন্মোচিত হলো বটে, সুশাসনের লক্ষণ দেখা গেল না। মাত্র পাঁচ বছরের মাথায়, আবারও গণতন্ত্রের উপর কঠোর আঘাত হলো, ৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি গণতন্ত্রকে কবর দেয়া হলো। শুরু হলো আন্দোলন সংগ্রাম। আবারো প্রাণ গেল সাধারণ জনতার। লীগ, বৈঠার আন্দোলন হল, বিচারপতির দরজায় লাথি হলো। ছাত্র, জনতার রক্তের বিনিময়ে আবারও আসলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসলো বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার।
২০০১ সালের ভোটে জনগণ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করে। সরকারে আসে বিএনপি। বাংলাদেশের ইতিহাসে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। বিধি বাম, বাংলাদেশের মানুষের কপালে সুখ সয় না। গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে একনায়কতন্ত্র হলো। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হাওয়া ভবন কমিশন বাণিজ্যের সূতিকাগার হয়ে উঠলো। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গিদের উত্থান হতে থাকলো। শাহ এএমএস কিবরিয়া, আহসানুল্লাহ মাস্টার এর মতো জনপ্রিয় মানুষদেরকে খুন করার মিশন শুরু হয়ে গেল। ঘটে গেল একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো জঘন্য সব হত্যাকাণ্ডের মিশন। আবারো শুরু হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলন। সামরিক ছত্র ছায়ার তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুরু করে নানা রকম নীলনকশা। আবারও ছাত্র জনতার রক্ত, আবারো প্রণাহানি।
ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে বিরাট জয় পায় আওয়ামী লীগ। তারুণ্য লুফে নেয় শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি। জনমনে পাহাড় সম প্রত্যাশা তৈরি হয়। দুর্নীতি, দুঃশাসন, অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলার স্বপ্নে বিভোর হয় নতুন প্রজন্ম। না, সেই স্বপ্নও বেশিদিন ঠেকেনি। ২০১৪ সালে গণতন্ত্রের সূর্যে কলঙ্ক লেপিত হয়। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে, অদ্ভুত এক কালো গণতন্ত্রে আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে বাংলার আকাশ। এর ধারাবাহিকতা এখনো চলমান। গণতন্ত্রের দুর্বলতার সুযোগে আমলাতন্ত্র লাগামহীন শক্তি অর্জন করে। বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামীলীগের কান্ডারী হয়ে ওঠে, ধনিক ব্যবসায়ী আর হাইব্রিড নামক সুবিধাবাদী লোভাতুর শ্রেণী।
ধারাবাহিক প্রশ্ন ফাঁসের হোলি খেলায় মেধাবীরা বঞ্চিত হয়। দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থপাচারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সদা নীতি বাক্য শোনানো, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ প্রধানের সম্পদের চিত্র দেখে জনগণের চোখ ছানাবড়া হয়ে ওঠে। আদর্শিক আওয়ামী লীগ নেতাদের পরিবর্তে, হাইব্রিডদের ক্ষমতায়নে পরীক্ষিত আর ত্যাগী আওয়ামী কর্মীরাও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। শিক্ষা, ব্যাংকিং, রাজস্ব থেকে শুরু করে সব পাবলিক সেক্টরে লুটপাটের এক অব্যাহত প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ক্ষোভে, দুঃখে ফুসতে থাকে জনগণ। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে শুরু হয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
ছাত্র সমাজের মাঝে আন্দোলনটি যখন চরম জনপ্রিয়তার দিকে ধাবিত হয়, ছাত্রলীগ তির্যক বাক্যবাণে তাদের আঘাত করতে থাকলো। সুপ্রিম কোর্টের আদেশ আর শাসকদলের বক্তব্যে প্রমাণিত হলো, দাবিটি যৌক্তিক ছিল। এমন যৌক্তিক দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে আন্দোলনটিকে ছাত্রলীগ নিজেদের করে নিতে পারতো। সেটি না করে, পেশীশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। নিজের সন্তান, ভাইবোনদের উপর নিষ্ঠুর ভয়াবহতার চিত্র দেখে, প্রতিবাদে ফেটে পড়লো সর্বশ্রেণীর মানুষ। সুযোগ নিলো বিরোধীরা, ঝরে গেল শত শত তাজা প্রাণ, ধ্বংসলীলা চললো সম্পদে। ৪১ এর উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্নের পথে, তৈরি হলো কঠিন প্রতিবন্ধকতা।
নূর হোসেনদের রক্ত আমাদের টেকসই গণতন্ত্র দিতে পারেনি। কাঞ্চন, দিপালী সাহার রক্ত সাম্যের সমাজ দিতে পারেনি। রাউফুন বসুনিয়ার রক্ত শোষণ মুক্ত অর্থনীতির অসাম্প্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থা দিতে পারেনি। বিপরীতে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে, দুর্নীতি দুঃশাসনের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন কোটিপতির জন্ম হয়েছে। যে আত্মত্যাগ আর জীবন বিসর্জন কিছু মানুষকে ফুলে ফেঁপে উঠার সুযোগ করে দেয়, সেই আত্মত্যাগ অর্থহীন। এ সময়ের ছাত্র আন্দোলনে শতাধিক তরুণের আত্মত্যাগ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে কাগুজে মুক্তি ঘটলেও, তরুণদের লালিত স্বপ্নের পথকে প্রশস্ত করবে না। যদি কোনদিন কোন আত্মত্যাগ সমাজকে বদলে দিতে পারে, আমি সেই আত্মত্যাগকে স্বাগত জানাতে চাই।
অসংখ্য মায়ের বুক খালি হয়েছে। স্বজন হারানোর বেদনায় পরিবারগুলো হাহাকার করছে। এঁরা তরুণদের এই আত্মাহুতির যন্ত্রণাকে বয়ে বেড়াবে অনাধিকাল। বিস্মৃত জাতি তরুণদের এই আত্মাহতির কথা ভুলে যেতে খুব বেশিদিন লাগবে না। আবারও শুরু হবে ক্ষমতার তোষণ। যে সময়ে রাঘব বোয়াল দুর্নীতিবাজদের মুখোশ উন্মোচিত হচ্ছিল, সেই সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত আন্দোলন মোকাবেলার কৌশল আগুনে ঘি ঢেলে দিল। প্রশিক্ষিত জঙ্গির দল এই আন্দোলনকে মহাপ্রলয়ে রূপ দিতে তাঁদের সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ধ্বংস করলো জাতির সব গৌরবোজ্জ্বল অর্জন। একের পর এক মেধাবী তরুণদের লাশে চারিদিকে গগন বিদারী হাহাকার শুরু হলো।
এ মৃত্যুর মিছিল শাসকদের নাড়া দিয়েছে, তবে শত্রু মিত্র চিনতে পারার মতো সচেতনতা তৈরি করতে পারবে কিনা, তাতে আমি সন্দিহান। দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তিটি হয়তো অনেক ঝিমিয়ে পড়তে পারে, তাতেও লাভবান হবে লোভাতুর শ্রেণী। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে সরকারকে অস্থিতিশীলতার মধ্যে রেখে, ফায়দা নেবে দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট। ২০২৪ এর এই অপ্রতিরোধ্য ছাত্র আন্দোলন সমাজকে তাহলে কি দিবে?
১৮ জুলাই এর পর থেকে অহিংস্র ছাত্র আন্দোলনটি কেন জঙ্গি রূপ ধারণ করলো, সেটি বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ধ্বংসলীলার আলামত গুলো, হঠাৎ গজিয়ে উঠা ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। যাঁরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৮৬ সালের ২৬ শে নভেম্বর দেখেছেন, যে বা যাঁরা ৮৬ থেকে ৯৬ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তাঁরা এই আন্দোলনের সর্বশেষ তিনদিনের গতি প্রকৃতির সাথে অনেক কিছুই মিলিয়ে নিতে পারবেন। পর্দার অন্তরালে যে উদ্দেশ্যটি লুকিয়ে ছিল, সেটি সফল হলেও বাংলাদেশ মুক্তি পেতো না, দেখা মিলতো আরো ভয়ংকর দুর্বৃত্ত ও হায়েনাদের। যে মৃত্যু সমাজের মুক্তির পথকে ত্বরান্বিত করে না, যে মৃত্যু নতুন কায়েমি স্বার্থবাদীদের জন্ম দেয়, যে মৃত্যু ভয়ংকর দানবীয় শক্তির উত্থান ঘটায় সে মৃত্যু অর্থহীন। সে অর্থহীন মৃত্যু আর চাইনা।
ইউ