ছবি: মো. মাহমুদ হাসান
গণতন্ত্র আর উন্নয়ন একে অপরের পরিপূরক। অস্বচ্ছ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কি উন্নয়ন কে বাধাগ্রস্ত করে? এ নিয়ে সুধী সমাজে বিতর্ক থাকলেও স্থানীয় সরকার-ই উন্নয়ন কর্মকান্ডে মূখ্য ভুমিকা পালন করে, এটি অস্বীকারের উপায় নেই। বাংলাদেশের মৌল কাঠামোতে গনতন্ত্রের উপস্থিতি, অনুপস্থিতি নিয়ে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক আছে। আবার স্থানীয় সরকারে শাসক দলের প্রতিনিধিরা বিশেষ আনুকূল্য পেয়ে থাকেন, এমন অভিযোগও হরহামেশা শুনা যায়। এতো সবের মাঝেও জোর দিয়ে বলা যায় বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী। এর মূল কারণ তৃণমূলে শক্তিশালী গণতন্ত্রের উপস্থিতি। ইউনিয়ন পরিষদ স্থানীয় সরকারের মূল ভিত্তি। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনগণের স্বতস্ফুর্থ অংশগ্রহণের যে চিত্র দেখা যায়, পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও এর নজির নেই।
অর্থ বিত্তের অনৈতিক প্রভাবে গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্থ হলেও, বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে এখনো জনমতের প্রতিফলন ঘটে। সমাজে প্রভাবশালী মানুষের দম্ভ দাপট যত বেশি দৃশ্যমানই হোক, সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ এখনও শান্তি প্রিয়। তাই স্থানীয় সরকারে তাদের মতামতেরই প্রতিফলন দৃশ্যমান হয়। বিগত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে যখন পরিবার, পরিজনের সমর্থনহীন প্রার্থী রেকর্ড সংখ্যক ভোটে জিতে যায়, তখন মূলত শক্তিশালী গনতন্ত্রের প্রক্রিয়াটির উপস্থিতিই প্রমাণিত হয়।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে প্রার্থীরা যে দল থেকেই নির্বাচিত হন, তাঁরা মূলত শাসক দলের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকেই বাস্তবায়ন করেন। উন্নয়ন বরাদ্দ একটি রুটিন প্রক্রিয়া, সকল জনপ্রতিনিধি-ই এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখেন। তবুও কেউ কেউ যুগ যুগ ধরে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন, আবার কেউ কেউ দ্বিতীয় বারেই বিপুল ভোটে হেরে যান। সরকারের রুটিন উন্নয়ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ, অনেক সময়ই পূন: নির্বাচিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রার্থীর ব্যাক্তিগত ক্যারিশমা এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। প্রয়াত সৈয়দ মোহাম্মদ আলমগীর হবিগঞ্জ জেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। টানা সাত মেয়াদে আমৃত্যু পয়ত্রিশ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। সাধারণের ভাষায় সামাজিক সংহতি ও শৃঙ্খলা রক্ষার অপূর্ব গুণাবলীর কারণেই জনগণ তাঁকে বার বার নির্বাচিত করেছে?
আমাদের গ্রামীণ সমাজে নানা কারণেই সামাজিক সংহতি ও শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়। জমি-জমা নিয়ে বিরোধ, পারিবারিক কলহ, গোষ্ঠী দ্ধন্ধ এমন পরিস্থিতি হরহামেশাই ঘটে। আর এসব পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধকে কেন্দ্র করে এক ধরনের সুবিধা ভোগী শ্রেণী তৈরী হয়। বিরোধের মাত্রা যতই বাড়ে, এই শ্রেণিটি ততই সমৃদ্ধ হয়। বিরোধ কে কেন্দ্র করে বাড়তে থাকে মামলা মোকদ্দমার সংখ্যা। মামলা মোকদ্দমা আর দ্ধন্ধ সংঘাত যত বাড়ে সুবিধা ভোগীদের আয় রোজগারও সমহারে বাড়তে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাতসারে জনপ্রতিনিধিরাও এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ভেঙে পড়ে সংহতি, বাড়তে থাকে সামাজিক অসন্তোষ। সমাজের শান্তি প্রিয় মানুষগুলো গনতন্ত্রের সুবিধা নিয়ে পরবর্তীতে বিকল্প প্রার্থীকে নির্বাচিত করে তাঁদের মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে। প্রচার আছে, শুধুমাত্র উন্নয়ন দিয়ে নয়, সামাজিক সংহতি রক্ষার সুদৃঢ় অবস্থানের কারণেই, আমৃত্যু প্রায় চার দশক সৈয়দ মোহাম্মদ আলমগীর হবিগঞ্জ জেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন।
অনেকে অভিযোগ করেন, শাসক দলের বিপরীত আদর্শের অনুসারী জনপ্রতিনিধিরা সরকারের শ্যান দৃষ্টিতে থাকেন। সরকারের গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সুদৃঢ় ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে সমর্থ হলে বিরোধী রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করেও জাতীয় পুরস্কার পাওয়া যায়, এমন উদাহরণও আমাদের সামনে দৃশ্যমান। তরুণ নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান সৈয়দ আতাউল মোস্তফা সোহেল। বযস আর অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ এমন বলারও কোন সুযোগ নেই। চিন্তা, চেতনায় শাসক দলের কেউ নন, তবুও জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রমে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেশ সেরা চেয়ারম্যানের খ্যাতি অর্জন করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তাজুল ইসলাম তাঁর হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা থাকলে, মতাদর্শগত ভিন্নতা উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দিতে পারে না, এটি তার জলন্ত উদাহরণ।
তরুণ প্রজন্মের মাঝে নৈতিক অবক্ষয়, আগামী দিনের বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মাদকের ভয়াবহতা, যেনতেন উপায়ে অর্থ উপার্জনের মোহ, পারিবারিক ও সামাজিক উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। মাদকের ছোবল শহরকে ছাড়িয়ে গ্রামগঞ্জের সুখী সুন্দর সমাজকেও আজ কলুষিত করে তুলছ। রূপ নিয়েছে এক ভয়াবহ সামাজিক সমস্যায়। আইনের শাসন, সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ, আর পুলিশী অভিযান কোন ভাবেই এর স্থায়ী সমাধান নয়। তরুণ সমাজকে পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা, শরীরচর্চাসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়েই এই সামাজিক সমস্যার টেকসই সমাধান সম্ভব।
বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের মতো বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ, তরুণ প্রজন্মকে বিপদগামী হওয়ার পথ থেকে দুরে সরিয়ে রাখতে পারে। স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা এক্ষেত্রে আলোকবর্তিকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন। রাজনীতির উর্ধে উঠে, সমাজ উন্নয়নের সুদৃঢ় ইচ্ছা শক্তি এক্ষেত্রে সবচেয়ে ফলদায়ক ভুমিকা রাখতে সক্ষম। গভীর দৃষ্টিতে অবলোকন করছি, যে তরুণ জনগোষ্ঠী তাদের অখণ্ড অবসরে, আড্ডাবাজি আর নানা অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে যেতো, এঁরা এখন সাজ সকালে মাঠে মাঠে ব্যায়ামের খসরত করে। দলে দলে সংঘবদ্ধ হয়ে রানার্স ইউনিটি গঠন করে, হাজার মিটার প্রতিযোগিতার দৌড়ে অবতীর্ণ হয়। মর্নিং সান, সূর্যমুখী এমন নানারকম সংগঠন তৈরি করে ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করে। দলে দলে সংঘবদ্ধ হয়ে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে তরুণ যুবকদের অংশগ্রহণের চিত্রটি সমাজের অবক্ষয় ঠেকাতে ক্রমান্বয়ে যেন একটি সামাজিক বিপ্লবের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। মাত্র এক বছরে হবিগঞ্জ জেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নে এই সামাজিক দৃশ্যপট পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি হতাশাগ্রস্ত সমাজে যেন আলোর ঝলকানি হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে!!
হাত বাড়ালেই ইয়াবা আর ফেনসিডিলসহ জীবন ধ্বংসকারী নানা রকম মাদকের ছড়াছড়ি !! অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে উদ্বিগ্ন, আদর্শ শিক্ষক সমাজ ছাত্রদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দিশেহারা। সুশীল সমাজপতিরা সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র দেখে হতাশাগ্রস্ত। এমন পরিস্থিতিতে কি যাদুমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে নোয়াপাড়ার তরুণ সমাজ আজ দলে দলে মাঠে যায়? শরীরচর্চা আর খেলাধুলা কে বিনোদনের পথ হিসেবে বেছে নেয়? এর মূলে রয়েছে স্থানীয় সরকারের এক তরুণ জনপ্রতিনিধি! নির্বাচনের আগে জনতার কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, জনসমর্থন পেলে মাদক নির্মূলে কাজ করবেন। অতি অল্প সময়েই তিনি হয়তো উপলব্ধি করেছেন, মাদক একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি। প্রশাসনিক পদক্ষেপ আর আইনের কঠোরতা, একে সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত করলেও, এটি সমস্যার কোন টেকসই সমাধান নয়। খেলাধুলা আর সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তরুণদের ব্যাপক অংশগ্রহণ বৃদ্ধির মাধ্যমেই এই সামাজিক সমস্যাকে মোকাবেলা করতে হবে।
স্থানীয় সরকারের যেসব জনপ্রতিনিধি উদ্ভাবনী শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসে, জাতীয় স্বার্থে তাদের প্রশাসনিক আনুকূল্য প্রয়োজন। মাদক কারবারি আর অনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ উপার্জনকারীদের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী। ঘাটে ঘাটে মাসোহারা দিয়ে ওরা এদের শক্তিকে আরো সংগঠিত করে। জনগণের সরাসরি ম্যান্ডেট থাকার কারণে, স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা নৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়। সৎ ও সাহসী এসব জনপ্রতিনিধি যদি, সামাজিক সমস্যা নিরসনে এগিয়ে আসে, এর ইতিবাচক প্রভাবে সমাজ সমৃদ্ধ হবে। কঠোর সরকারি নজরদারির পাশাপাশি, রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নেতৃবৃন্দের অকুন্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা পরিস্থিতি পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। হারিয়ে যাওয়া ফুটবলকে জাগিয়ে তোলে, ব্যারিস্টার সুমন সেই পরিবর্তনের দৃষ্টান্তটি সমাজের সামনে নিয়ে এসেছেন। দল,মত পথের ঊর্ধে উঠে কিশোর, তরুণদের মাঠমুখি করার আহ্বানকে স্বাগত জানাতে হবে। সেক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ, সামাজিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ কান্ডারী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
ইউ