
ছবি সংগৃহীত
উন্নত জীবন এবং একটি যত্নশীল সমাজ বিনির্মাণের মাধ্যমে দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য । দেশের পশ্চাৎপাদ ও দরিদ্র্য মানুষদের জীবনমান উন্নয়ন তথা দারিদ্র্যমোচনে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চলমান রেখেছে। সামাজিক কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা, অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কর্মসূচি, বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কর্মসূচি, ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর সঠিক কর্মসংস্থানে কর্মসূচি, ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকপ্যারালাইজড, জন্মগত হৃদরোগ, থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে কর্মসূচি ইত্যাদি। সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ দিয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা যা গত অর্থবছরে তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। দেশের কম বেশি একতৃতিয়াংশ মানুষ সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা আওতায় এসেছে । এই সব খাতে সরকার জিডিপির মোট ২.৫৫ শতাংশ ব্যয় করে থাকে। যা টাকার অংকে এক লাখ তের হাজার কোটি টাকারও বেশি।
চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার দিঘলদী গ্রামের ৬৫-ঊর্ধ্ব আবদুল বারেক। তার মোবাইল ব্যাংকিং ‘নগদ’ হিসেবে বয়স্ক ভাতার এক বছরের ৬ হাজার টাকা জমা হয়। অসহায় এ বৃদ্ধ টাকা পেয়ে খুবই খুশি। নিজের চিকিৎসা খরচ মেটানোর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র কেনার পরিকল্পনা করেছেন তিনি। শুধু আবদুল বারেকই নয়, তার মতো হাজার হাজার বৃদ্ধারা মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে টাকা পেয়ে যাচ্ছেন খুব সহজেই।
বয়স্ক ভাতার নীতিমালায় বলা হয়েছে, পুরুষের বেলায় ৬৫ বছর বা তার বেশি এবং নারীর বেলায় ৬২ বছর বা তার বেশি বয়স্ক নাগরিকরা ভাতার জন্য বিবেচিত হন। তবে বেশি বয়স, শারীরিক সক্ষমতা, নিঃস্ব, উদ্বাস্তু, ভূমিহীন, বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত, বিপত্নীক, নিঃসন্তান, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বসতবাড়ি ছাড়া অন্যান্য জমির পরিমাণ আধা একর হলেই তাকে ভূমিহীন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যাদের বছরে গড় আয় ১০ হাজার টাকার বেশি নয়, তারা এ সুবিধা পান। বয়স্ক ভাতা কর্মসূচির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো বয়স্ক জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধান। পরিবার ও সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি, আর্থিক অনুদানের মাধ্যমে তাদের মনোবল জোরদারকরণ এবং চিকিৎসা ও পুষ্টি সরবরাহ বৃদ্ধিতে তাদেরকে সহায়তা করা।
দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ দুস্থ ও স্বল্প উপার্জনক্ষম অথবা উপার্জনে অক্ষম বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে ও পরিবার ও সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে ‘বয়স্কভাতা’ কর্মসূচি প্রবর্তন করা হয়। প্রাথমিকভাবে দেশের সকল ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিটি ওয়ার্ডে ৫ জন পুরুষ ও ৫ জন মহিলাসহ ১০ জন দরিদ্র বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে প্রতিমাসে ১০০ টাকা হারে ভাতা প্রদানের আওতায় আনা হয়। পরবর্তীতে দেশের সকল পৌরসভা ও সিটিকর্পোরেশন এ কর্মসূচির আওতাভুক্ত করা হয়। বর্তমান সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৮ লক্ষ ০১ হাজার বয়স্ক ব্যক্তিকে জনপ্রতি মাসিক ৬০০ টাকা হারে ভাতা প্রদান করছে এবং তাদের এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪২০৫.৯৬ কোটি টাকা।
বর্তমানে বয়স্কভাতা কার্যক্রমে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ এবং সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তা হলো; ২০১৩ সালে প্রণীত বাস্তবায়ন নীতিমালা সংশোধন করে যুগোপযোগীকরণ, অধিক সংখ্যক মহিলাকে ভাতা কার্যক্রমের আওতায় অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে মহিলাদের বয়স ৬৫ বছর থেকে কমিয়ে ৬২ বছর নির্ধারণ, উপকারভোগী নির্বাচনে স্থানীয় মাননীয় সংসদ সদস্যসহ অন্যান্য জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্তকরণ এবং ডাটাবেইজ প্রণয়ন। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছর থেকে বয়স্ক ভাতা কর্মসূচির আংশিক এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। বর্তমানে সকল উপকারভোগীকে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডার নগদ ও বিকাশ এবং এজেন্ট ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে জিটুপি পদ্ধতিতে (গভর্মেন্ট টু পারসন) ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ২৫টি ক্যাশভিত্তিক কর্মসূচির মধ্যে ২২টি কর্মসূচির অর্থ সরাসরি উপকারভোগীর ব্যাংক হিসাব বা মোবাইল ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে ক্যাশভিত্তিক অবশিষ্ট কর্মসূচিসমূহ জি-টু-পি পদ্ধতির আওতায় আনার সিদ্ধন্ত নিয়েছে সরকার। বর্তমানে ৮০ শতাংশের অধিক ক্যাশভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ভাতা জি-টু-পি পদ্ধতিতে প্রদান করা হচ্ছে।
কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে সমাজের দরিদ্র ও বৈষম্যের শিকার মানুষের দরিদ্রতা ও বৈষম্য হ্রাস করার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ সরকার বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, ভিজিএফ, ভিজিডি, হিজড়া জনগোষ্ঠী, চা-শ্রমিক, দলিত, হরিজন ও বেদে সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। উপজেলা ও শহর সমাজসেবা অফিস, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তরসহ সরকারি অন্যান্য দপ্তরের মাধ্যমে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। সেবাভোগী বাছাইকরণের প্রধান ভূমিকা পালন করছে ইউনিয়ন পরিষদ।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের ঝুঁকিপূর্ণ, অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষাকে আইনি বলয়ের আওতায় আনার জন্য বর্তমান সরকার ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন ২০১১, শিশু আইন ২০১৩, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩, পিতামাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩, নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন ২০১৩ এবং বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ আইন ২০১৯। মূলতঃ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা সম্প্রসারণ, বাজেট বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আইন প্রণয়ন ও বিভিন্ন কৌশলগত সংস্কারের ফলে বর্তমান সরকারের হাত ধরে কল্যাণকর রাষ্ট্রের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। আমরা সকলেই জানি যে আমাদের সম্পদ সীমিত, কিন্তু চাহিদা অসীম। ফলে সাধ এবং সাধ্যের মধ্যে একটি বিরাট ফারাক রয়েছে। স্বল্প সাধ্যের মাধ্যমে কীভাবে ব্যাপক সাধ পূরণ করা যায় সেটি বাস্তবে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন বর্তমান সরকার । বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে গেছেন শেষ দিন পর্যন্ত। তার জীবনের মূল দর্শন ছিল বাংলার গরিব -দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। সরকার বাংলাদেশের জনগণ এবং বহির্বিশ্বের কাছে একটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে যে- কোনো কিছু অর্জন করার বাসনা থাকলে মানুষের সাধ্য যত কমই থাকুক না কেন, সেই লক্ষ্য অর্জন করা অসম্ভব নয়।
বাংলাদেশকে একটি সক্ষম ও সমর্থবান রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য সরকারের অঙ্গীকার দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। এর দীর্ঘমেয়াদি সুফল ইতিমধ্যে দেশের জনগণ পেতে শুরু করেছে। ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ এবং নিরাপদ ব-দ্বীপ পরিকল্পনার রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। উন্নত বাংলাদেশের অভিযাত্রায় প্রথম ধাপ হিসেবে এর মধ্যেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে । বাংলাদেশের লক্ষ্য এখন স্মার্ট বাংলাদেশ। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি—এ চারটি মূল ভিত্তির ওপর গড়ে উঠবে ২০৪১ সাল নাগাদ একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী, স্মার্ট বাংলাদেশ।
ইউ