
সংগৃহীত ছবি
সময়ের যে পরিবর্তন হয়েছে এটি আমাদের বুঝতে হবে। নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করতে প্রথমে ব্যক্তি হিসেবে বৈষম্যের স্তর বুঝতে হবে। ধারাবাহিক ভাবে ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রত্যেকের অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে সাংগঠনিক লক্ষ্য বাস্তবায়নে থাকা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সচেতন ও কৌশলী হওয়ার আহ্বান জানালেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতির ডা. ফওজিয়া মোসলেম।
আজ শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ৯ টায় রাজধানীর পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনে সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম এ আহ্বান জানান।
“দক্ষ সংগঠক গড়ে তুলি, সংগঠনকে সংহত করি”-এই স্লোগানকে সামনে রেখে সংগঠনের উদ্যোগে “নারী আন্দোলনের আগামী কর্মসূচি এবং চ্যালেঞ্জসমূহ’’ বিষয়ক দিনব্যাপী সভা অনুষ্ঠিত হয় । অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় পতাকা ও সংগঠনের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে উদ্বোধনী অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন ঢাকা মহানগর কমিটির সৈয়দা রত্না, মাধবী বণিক, প্রজ্ঞা লাবনী সাদিয়া এবং রোকেয়া সদনের তত্বাবধায়ক অশ্রু ভট্টাচার্য। স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। বাংলাদেশের নারী আন্দোলন ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ- বিষয়ক আলোচনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম।অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় সংগঠন সম্পাদক উম্মে সালমা বেগম।
ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, যেকোনো কাজে মূল্যায়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার চাহিদা সময়ের সাথে সাথে বদলে যায়। নারীর ক্ষমতায়নের পথে থাকা সংকটকে মোকাবেলা করে ও তাকে অতিক্রম করে আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। তিনি আরো বলেন, তৃণমূল কর্মীদের ক্রমাগত কন্ঠস্বর ধরে রাখার জন্য সংগঠনের কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় নারীর চলার পরে থাকা সংকটগুলো মোকাবেলা করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। সম্মিলিতভাবে নারী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য কর্মসূচি গ্রহণের পাশাপাশি কাজ কিভাবে এগিয়ে যাবে সেবিষয়ে ভাবতে হবে। স্বেচ্ছাসেবার মনোভাবকে বেশি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে।
মালেকা বানু বলেন, জাতীয় ও বৈশ্বিক নারী আন্দোলনের পরম্পরায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের জন্ম । একইসাথে মুক্তিযুদ্ধের চিন্তা -চেতনার মধ্য দিয়েই সংগঠন যাত্রা শুরু হয়েছে। নারী-পুরুষের সমতার কথা বলা হচ্ছে। বর্তমানে নারীর অবস্থার কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন হলেও বর্তমানে নারীর অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নে এখনো কিছু বিষয় মীমাংসিত নয়। নারী এখনো বিভিন্ন ধরণের সহিংসতার শিকার হচ্ছে, পারিবারিক ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নারীর প্রতি অতিরিক্ত দায়িত্ব এখনো কমে নাই। সিদ্ধান্ত গ্রহণে এখনো সীমাবদ্ধতা আছে। নারীর মানবাধিকার সম্পর্কে ভিয়েনা সম্মেলনে বলা হলেও বাস্তবে তার সঠিক বাস্তবায়ন হয়নি। নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি এসময় অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন ও নারী আন্দোলনেরপথ তৈরির উপর গুরুত্বরোপ করেন।
সীমা মোসলেম বলেন, ৫৫ বছরে মহিলা পরিষদের কাজের পরিবর্তন হয়েছে, নারীর অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে, রাষ্ট্র কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। মহিলা পরিষদ সময়ের পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় অধিকারভিত্তিক, আন্দোলনমূখী এবং স্বেচ্ছাসেবী গণ নারীকে সংগঠন হিসেবে কাজে ধারাবাহিক পরিবর্তন এনেছে। তিনি সংগঠনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও আদর্শ সম্পর্কে আলোচনা করতে যেয়ে বলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র একই সাথে বিাভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে অগ্রসর হচ্ছে। নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রকে গুরুত্ব দিয়ে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করতে যেয়ে ১৯৭০ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সংগঠনের ধারাবাহিক সাংগঠনিক কর্মতৎপরতার উল্লেখ করে বলেন পরও সমাজে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো, প্রথা আইন জীবন্চারণের কারণে এখনো নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথে, নারীর সম অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় পথ মসৃণ নয়। পথে থাকা বিভিন্ন বাধা মোকাবেলায় নারী আন্দোলন কে সামাজিক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
উদ্বোধনী অধিবেশন শেষে কর্ম অধিবেশনে “নারী আন্দোলনের আগামী কর্মসূচি এবং চ্যালেঞ্জসমূহ” এর উপর ০৬ টি দলে ৫৫ টি জেলা শাখার সংগঠক, তরুণী সংগঠক ও কর্মীবৃন্দের অংশগ্রহণে (২২৯ জন) দলীয় কাজ অনুষ্ঠিত হয়। দলীয় কাজ উপস্থাপন শেষে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
কর্মঅধিবেশনে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবা কানিজ কেয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার।
অধ্যাপক মাহবুবা কানিজ কেয়া বলেন, একজন সংগঠক সমাজের অংশ। দক্ষ সংগঠক হিসেবে গড়ে উঠতে পরিবার থেকে আসা বাধা দূর করতে সমাজে নারী সংগঠকের ভূমিকা নিয়ে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে হবে। সংগঠকদের মহিলা পরিষদের গঠনতন্ত্র সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখার পাশাপাশি সাংগঠনিক আদর্শকে ধারণ করতে হবে।
অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বলেন, নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, টেকসই সমাধানের জন্য নারীর ঘরে-বাইরের কাজে সমতা নিয়ে আসতে হবে; চিরাচরিত প্রথা ভাঙতে নারীকে মজুরির জন্য নয় মর্যাদার জন্য আন্দোলন করতে হবে; বৈষম্য শুরু হয় পরিবার থেকে, পরিবার থেকে বৈষম্য দূরের কাজ শুরু করতে হবে; রাজনীতিবিদদের জেন্ডার সংবেদনশীল করে গড়ে তুলতে গ্রুমিং করতে হবে; বিয়ে বিচ্ছেদের প্রভাব সন্তানের উপর কেমন সেবিষয়ে গবেষণা করতে হবে; আইন সম্পর্কে জানতে হবে; নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক প্রচারণা রোধে কনটেন্ট এনলিসিস এর উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, সংগঠনের কাজ এগিয়ে নিতে স্বতস্ফূর্তভাবে মতামত প্রকাশের প্রয়োজন আছে। প্রযুক্তিকে না ঠেকিয়ে ইতিবাচক ব্যবহার করতে হবে; নিজেদের সক্রিয় রাখতে হবে; নিজেদের তথ্য-প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে হবে; প্রযোজন ও পরিস্থিতি অনুসারে তথ্যের ব্যবহার যথাযথ হতে হবে। আইন নিয়ে সচেতনতার কথা বলা হয় কিন্তু আইন অমান্য করার প্রবণতা দূর করার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
//এল//