
সংগৃহীত ছবি
পাঠ্যবই থেকে আদিবাসী শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাদ দেওয়া এবং প্রতিবাদরত আদিবাসীদের উপর হামলার প্রতিবাদে ৬ দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা।
আজ শুক্রবার বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের উদ্যোগে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশে এই দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা।
মানবাধিকার কর্মী দীপায়ন খীসার সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। এছাড়া সংহতি বক্তব্যে দেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ সাধারণ সম্পাদক ডা. গজেন্দ্রনাথ মাহাতো, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুল রশীদ ফিরোজ, গণফোরামের সভাপতি পরিষদের সদস্য এ্যাড. সুব্রত চৌধুরী, বাংলাদেশ জাসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করিম সিকদার, এএলআরডির নির্বাহী প্রধান শামসুল হুদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড.খায়েরুল ইসলাম, আদিবাসীদের ছাত্র নেতা অলিক মৃ প্রমুখ।
অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে সবাইকে বাঙালি বানিয়ে দেওয়ার যে কাজ সেটা উগ্র জাতীয়তাবাদ। একিসাথে যে গ্রাফিতি অংকন করা হয়েছিল সেটা মুছে ফেলার যে চেষ্টা সেটাও উগ্র জাতীয়তাবাদ, এটি দেশের বহুত্ববাদকে অস্বীকার করা। আজকে বাংলাদেশে যে বহুত্ববাদের কথা বলা হচ্ছে আসলে বহুত্ববাদ মানে কি? বহুত্ববাদ মানেই হচ্ছে বাঙালি ছাড়া বাংলাদেশে যে ৫০ টির অধিক জনগোষ্ঠীর বসবাস সেসব জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ তাদের সকল অধিকার বাস্তবায়ন করায় হচ্ছে বহুত্ববাদ।
তিনি আরো বলেন, আগত ২৪ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণসংযোগ বিভাগ থেকে যে সকল ছাত্র রা অবদান রেখেছিল তাদের মধ্যে রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা একজন ছিল। ঢাকা মতিঝিলে স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি নামক সংগঠনটি রাপাইয়া উপর হামলা করে যা এখনো অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হয়নি। তাই হামলাকারীদের যদি দ্রুত সময়ে আইনের আওতায় আনা না হয় তাহলে ছাত্র জনতা এবং জনগণ কঠিন থেকে কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
গজেন্দ্রনাথ মাহাতো বলেন, বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিলো তারপরেও আজকে বাংলাদেশে আদিবাসীদের সাথে বৈষম্য হচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি গত ১৫ জানুয়ারি আদিবাসী ছাত্র জনতার উপর যারা হামলা করেছে তারা এখনো প্রশাসনের চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেশের প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। তিনি অবিলম্বে হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের জোর দাবি জানান।
করিম সিকদার বলেন, ২৪ গণঅভ্যুত্থানের পর যে গ্রাফিতি সারা বিশ্বের মানুষ দেখলেও সেই গ্রাফিতি মুছে ফেলার রাজনীতি করছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। গণঅভ্যুত্থানের পর কারা এই অরাজনৈতিক সরকারকে নিয়ে রাজনীতির চেষ্টা করছে তাদেরকে প্রতিহত করতে হবে। আর গণতন্ত্রকামী জনতা সেটা প্রতিহত করবে বলে আশা ব্যক্ত করেন।
আদিবাসী ছাত্র নেতা অলিক মৃ বলেন, তার সংহতি বক্তব্য বলেন- ফ্যাসিবাদী সরকার পতনের আন্দোলনে আমরা আদিবাসী ছাত্র জনতাও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেছিলাম। বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে আজকে আমাদের আদিবাসীদের উপর বৈষম্য জারি রাখা হয়েছে। যারা আজকে বাংলাদেশের বহুবৈচিত্র্যটাকে ধ্বংস করতে চাই, মুছে ফেলতে চাই তারাই প্রকৃত বিচ্ছিন্নতাবাদী।
তিনি আরও বলেন, যারা আদিবাসী ছাত্রদের হামলায় অংশ নিয়েছে তাদের অচিরেই শান্তির আওতায় আনতে হবে এবং যারা আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসার ব্যয়ভার সরকারকে নিতে হবে একিসাথে আদিবাসী শব্দ যুক্ত গ্রাফিতি পুনর্বহাল করতে হবে।
শামসুল হুদা বলেন, যে সংবিধানের দোহাই দিয়ে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের হামলা করা হয়েছে সেই সংবিধানে আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করা যাবেনা এমন বিধান কোথাও নেই। তিনি অনতিবিলম্বে অন্তবর্তীকালীন সরকারকে আদিবাসী বিষয়ক পরিপত্র জারি করার জোর দাবি জানান, যেখানে রাষ্ট্র ব্যবস্থার সব জায়গায় আদিবাসী শব্দ পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। এবং হামলাকারীদের গ্রেপ্তারসহ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করাসহ আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানান।
জোবাইদা নাসরিন বলেন, বহুত্ববাদ, সামাজিক ন্যায় বিচারের যে আলাপ সংবিধান সংস্কার কমিটি সামনে নিয়ে এসেছে সেই বহুত্ববাদের আলাপ তোলার পরপরই ১৫জানুয়ারি আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করা হলো, তারা কি জবাব দিবেন?
এ্যাড. সুব্রত চৌধুরী বলেন, আজকে দেশে জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। যে বৈষম্যবিরোধী চেতনার থেকে বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান সাফল্য লাভ করেছে সেই চেতনা এখন আমাদের আশাহত করছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান সংস্কারের যে বিষয়টা সামনে নিয়ে এসেছে তারা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার দর্শন অনুসরণ না করলে ব্যর্থ হবেন।
সাইফুল হক বলেন, আদিবাসী শব্দ যুক্ত গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে আদিবাসী ছাত্র জনতার মিছিলে যে তা এই নতুন বাংলাদেশে নজিরবিহীন ঘটনা। তিনি স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি নামে যে সংগঠনটি সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে জাতীয় পতাকার অবমাননা করে আদিবাসীদের উপর হামলা করেছে সবাই আইনের আওতায় এনে শাস্তির জোর দাবি জানান।
তিনি আরো বলেন, পাহাড় এবং সমতলের আদিবাসীদের ভুমির অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে এবং তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি স্বীকৃতি দিয়ে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।
৬টি দাবিনামার মধ্যে হলো, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক (এনসিটিবি) কার্যালয়ের কাছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিবাদরত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর নাগরিক ও শিক্ষার্থীদের উপর বর্বরোচিত আক্রমনের দ্রুত উচ্চ পর্যায়ের নিরপেক্ষ তদন্ত করে এই হামলার সঙ্গে যুক্ত সকল সন্ত্রাসীকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
গত ১৪ জানুয়ারি, হামলায় আহত সকল আদিবাসী শিক্ষার্থী ও নাগরিকদের সুচিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে সুনিশ্চিত করা।
হামলার জন্য দায়ী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পেছনে কোন বিশেষ মদদদাতা গোষ্ঠী সক্রিয় ছিল কিনা তাও দ্রুত শনাক্ত করে তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতসহ জড়িতদের আইন অনুযায়ী শান্তির ব্যবস্থা করা।
পাঠ্যপুস্তকে আদিবাসীদের যথাযথ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত অধ্যায় যুক্ত করা।
আদিবাসী শব্দযুক্ত যে গ্রাফিতি প্রত্যাহার করে ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানকে কার্যত অসম্মানিত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে তার জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃপক্ষকে অভুত্থানের মূল নায়ক ছাত্র-জনতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে এং প্রত্যাহৃত গ্রাফিতি যথাস্থানে যথা মর্যাদায় পুনঃস্থাপন করা।
স্বঘোষিত হামলাকারীদের পূর্বপরিকল্পিত হামলা প্রতিরোধে আইন শৃংখলার দায়িত্বপ্রাপ্ত বাহিনীর সদস্যরা কেন নীরব ছিলেন বা ব্যর্থ হলেন তার সুস্পষ্ট ও সন্তোষজনক ব্যাখ্যাও দেশবাসীকে সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানো।
এছাড়াও উক্ত সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংসদ(বাগাছাস), বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, আদিবাসী যুব ফোরাম, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টসহ অন্যান্য প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনসমূহ।
//এল//