
ছবি: উইমেনআই২৪ ডটকম
পরিবেশ দুষণসহ চাষাবাদে কীটনাশক ব্যবহার করায় শাক বিষাক্ত হয়ে যায়। যে কারণে শাক খাওয়া ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। আমরা নয়া কৃষির প্রচলন, বিষমুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতে পারলে এই শাক আমরা সবাই খেতে পারবো বললেন মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
রবিবার (১৩ এপ্রিল) সকালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত মঞ্চে নবপ্রাণ আন্দোলনের আয়োজনে ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় দুদিন ব্যাপী চৈত্র সংক্রান্তি ও বৈশাখ উদযাপনের প্রথম দিনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার একথা বলেন।
উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ও সাধকরা দু দিনব্যাপী চৈত্র সংক্রান্তি ও বৈশাখ উদযাপনের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী গান পরিবেশন করেন শিল্পী আলেয়া বেগম। এছাড়াও অংশ নেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, বক্তব্য দেন কবি ও নয়া কৃষি সংগঠক ফরহাদ মজহার। স্হানীয় ১২৭টি দেশী ধানের উপর নিজের লেখা গান পরিবেশন করেন টাংগাইলের নয়া কৃষির কৃষক আক্কাছ আলী। দোহার করেন আরফান আলী। ধামাইল নৃত্য ও গান পরিবেশন করেন সুনামগঞ্জের দল। বিভিন্ন ধরনের গান পরিবেশন করেন হাশেম আলী, সাইদুর রহমান প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন উবিনীগের পরিচালক সীমা দাস সীমু।
উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, দুপুরে এখানে ১৪ রকমের শাক খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার সাথে রয়েছে লাল চালের ভাত। সাধুসঙ্গদের কাছ থেকে জানার সুযোগ হয়েছে, এই শাক তারা নিজেরা কুড়িয়ে খান। তাদের শিষ্যরা এই শাক কুড়িয়ে এনে রান্না করেন। তারা মাছ, মাংস, পেঁয়াজ, রসুন খান না।
তিনি আরো বলেন, তারা যে জীবন ব্যবস্থায় জীবন পরিচালনা করেন, সেই জীবন ব্যবস্থার মধ্যে প্রকৃতি রক্ষার বিষয় রয়েছে। অন্যদিকে কৃষিতে নারীর যে জ্ঞান রয়েছে তার স্বীকৃতি নেই। কারণ নারীরা উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বড় বড় গাছ সম্পর্কে বলতে পারলেও শাকের বিভিন্ন গুণাগুণ ও রান্নার পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে পারেন না।
তিনি বলেন, ‘আমরা দেশের উন্নতির কথা বলছি, দেশকে আমরা এগিয়ে নিতে চাচ্ছি। জুলাই গণ অভুত্থানের পর আমরা যে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি সেখানে যেন শুধু ভবন আর গাড়ি উন্নয়নের সংগা না হয়। আমরা যেন প্রকৃতিকে রক্ষা করতে পারি। চৈত্র সংক্রান্তি পালন করতে গিয়ে শাক খুঁজতে বেগ পেতে না হয়। আশা করছি সরকার এটাই মেনে চলবে।’
ফরহাদ মজহার বলেন, আমাদের সংস্কৃতিতে সময়ের ধারণা সরলরৈখিক নয়, বরং বৃত্তাকার। কালকেন্দ্রিক না, ঋতুকেন্দ্রিক। চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ। এটি আসলে আলাদা দুইদিনের উৎসব নয়। উৎসব একটাই। সংক্রান্তি যে মুহূর্তে শেষ সেই একই মুহূর্তে বৈশাখেরও আরম্ভ। তাই দুইদিনের উৎসবকে আমরা একই উৎসব গণ্য করে 'উৎসব বাংলাদেশ ১৪৩১/১৪৩২' নামে পালনের জন্য সকলকে আহ্বান জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, জুলাই গণঅভুত্থান রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে আমাদের চেতনার জগতে গুণগত রূপান্তর ঘটিয়ে দিয়ে গেছে, নতুন ভাবে নিজেদের নিয়ে ভাবনা এবং নিজেদের নতুন ভাবে গঠন করবার প্রণোদনা তৈরি করেছে। নতুন উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতাকে শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের মূর্ত করে তুলতে হবে। তাই এবার আমরা চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখের প্রথম দিনকে সকলের কাছে একই মালায় গেঁথে একই সঙ্গে পালন করবার প্রস্তাব দিচ্ছি। কারণ আমাদের সংস্কৃতি সরলরৈখিক কালকেন্দ্রিক না, ঋতুকেন্দ্রিক। ঋতুর বৃত্তে শেষ বলে কিছু নাই। প্রতিটি বিন্দু একই সঙ্গে বৃত্তের শেষ এবং আবার একই বৃত্তের শুরু বটে। উপনিবেশিক শাসনের আগে উৎসবের ঋতুকেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল প্রবল ও শক্তিশালী। ক্যালেন্ডার ধরে আমরা নববর্ষ পালন করি নি। চিত্রা নক্ষত্রের সৌর যাত্রা অনুসরণ করে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করেছি, যা একই সঙ্গে নববর্ষেরও শুরু। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে আমাদের কালচেতনা ও উৎসবের ধারণাকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করতে হবে। তার জন্য আমরা দুই স্তরে উৎসব নিয়ে আলোচনা করব। প্রথম পর্বে উৎসব নিয়ে রাজনৈতিক-দার্শনিক পর্যালোচনা যেন উৎসবের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব শুধু নয়, ভাবগত ও রাজনৈতিক তাৎপর্য বুঝি। দ্বিতীয় পর্বে সুনির্দিষ্ট ভাবে চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষ নিয়ে আলোচনা।
ফরহাদ মজহার বলেন, ঋতু আমাদের দেশে বারবারই ফিরে আসে। পুরাতনই নতুন রূপ নিয়ে নতুন সাজপোশাকে আমাদের সামনে হাজির হয়। পুরাতনকে তাই আমরা 'আবর্জনা' বলে উড়িয়ে দেই না, কারন তাতে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকেও উড়িয়ে দেওয়া হয়ে যায়। ইতিহাস ও ঐতিহ্য স্থির কিছু নয়, গতিশীল। তার যেমন পরম্পরা আছে তেমনি তার বয়ানেরও পরম্পরা আছে যা 'বাচনিক পরম্পরা' নামে আজকাল পরিচিত। আমরা নিজেদের সম্পর্কে নতুন গল্প রচনা করতে চাইলেও ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কাছেই আমাদের ফিরে যেতে হয়। তথাকথিত 'পুরাতন'-কে বৈশাখী ঝড়ে 'আবর্জনা' জ্ঞান করে উড়িয়ে ফেলে দেওয়া কাজের কথা নয়। 'আধুনিকতা'-র নামে আমরা পাশ্চাত্যকে নির্বিচারে গ্রহণ করতে গিয়ে এই কাজ এতোকাল করেছি।
উৎসবে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্ক বিকাশের সুযোগ থাকে। সেই সুযোগও আমরা গ্রহণ করি। কিন্তু উৎসবকে রাজনৈতিক ভাবে বিচার ও বোঝার বড়সড় ঘাটতি আছে আমাদের। সামাজিক মিলন ও পারস্পরিকতার মধ্য দিয়ে সামাজিক-সামষ্টিক সত্তা আমরা টের পাই। কিন্তু প্রকাশ করবার উপযুক্ত ভাষা আমরা এখনও তৈরি করতে পারি নি। সামাজিক ও রাজনৈতিক সত্তার উপলব্ধি ও বিকাশ ছাড়া রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে আমাদের বিকাশও সম্ভব না। এই বিকাশ ছাড়া আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র সভায় আমরা শক্ত ভাবে দাঁড়াতে পারব না। এই দিকটা আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিস্কার না। সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে রাজনৈতিকতার সমৃদ্ধ গভীর। উৎসবকে আমরা সেভাবে জাতীয় ভাবে চর্চাও করি না। এটা ঠিক যে রাষ্ট্রের তরফে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ও উৎসব আয়োজন করা হয়, কিন্তু জনগণ নিজেদের উদ্যোগে নিজেরা যদি কোন 'জাতীয় উৎসব' পালনের তাগিদ বোধ না করে তাহলে বুঝতে হবে আমাদের সামষ্টিক রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটবে না।
কুড়িয়ে পাওয়া শাক তোলা, পাঁচ মিশালী শাকের বড়া তৈরি, বিভিন্নভাবে শাক রান্না ইত্যাদির ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। দুপুরে চৌদ্দ রকমের শাক, ভাত ভর্তা পরিবেশন করা হয়। বিকেলে আমাদের সংস্কৃতি বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
ইউ