
সংগৃহীত ছবি
সম্প্রতি পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ পালনের ঐতিহ্যগত নানা আয়োজন ও অনুষ্ঠান নিয়ে এক শ্রেণীর উগ্রসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যে বিতর্ক সৃষ্টি এবং উগ্র আচরণের উস্কানি দেবার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে তার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশের ১৮ নাগরিক।
বিবৃতিতে বলা হয় “ আমরা তীব্র ক্ষোভ ও গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছি, গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক মিডিয়ায় কিছু উগ্র সাম্প্রদায়িক মহল আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ পহেলা বৈশাখ নববর্ষ পালন ও তার নানা অনুষ্ঠান নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টির অছিলা খুঁজে বেড়াচ্ছে। বর্ষ বরণের শোভাযাত্রায় কি ধরণের পোষাক পরা যাবে, কি ধরণের প্লাকার্ড বহণ করা যাবে অথবা যাবে না এই সব অযাচিত অনধিকার চর্চার ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে চলেছেন। তাদের এই সকল বিবৃতি এবং উগ্র আচরণের হুঙ্কার আমাদের পঞ্চাশ ষাটের দশকে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর সেবাদাস উগ্র সাম্প্রদায়িক মহলের সন্ত্রাসী আচরণের কথা মনে করিয়ে দেয়।
এই দেশের আপামর জনগণ দলমত নির্বিশেষে অসংখ্য সংগ্রাম ও ’৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ঐ সকল ধর্মব্যবসায়ী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সকল অপচেষ্টা পরাজিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল। ২০২৪ সালের জুলাই ছাত্র-জনতার অভুত্থানের মধ্যদিয়ে আমরা নিষ্ঠুর কর্তৃত্ববাদী, গণহত্যাকারী লুটেরা সরকারকেও উৎখাত করে জবাবদিহিমূলক সুশাসন, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং অসাম্প্রদায়িক ও ন্যায় বিচার ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগের জন্য স্ব স্ব অবস্থান থেকে উদ্যোগী হয়েছি। এই সময় পহেলা বৈশাখ নববর্ষ পালনের অনুষ্ঠান নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি কিংবা তার কোন অনুষ্ঠানের উপর অযাচিত বিধি নিষেধ আরোপের মহল বিশেষের অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচেষ্টা কোনভাবেই কাম্য নয়। আমরা ঐ মহলের উগ্র সাম্প্রদায়িক বিবৃতি এবং উস্কানিমূলক বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। একই সাথে অন্তবর্তী সরকার এবং বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং আইন শৃংখলার দায়িত্বে নিয়োজিত সকল প্রতিষ্ঠানের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি যে, পহেলা বৈশাখ স্বাধীন ও সুশৃংখলভাবে পালনে বাধাদান কিংবা উস্কানীমূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত ব্যক্তি, মহল ও সংগঠনগুলিকে যে কোন ধরণের অপতৎপরতা থেকে বিরত রাখতে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, পহেলা বৈশাখ পালন যেমন কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, তেমনি তার সঙ্গে ধর্ম বিশ্বাসের সংঘাত নেই। মোগল সম্রাট আকবরের শাসন আমল থেকে এই জনপদের ধর্ম-বর্ণ- জাতিগোষ্ঠী নির্বিশেষে সকল মানুষ নারী-পুরুষ শত শত বছর ধরে এই উৎসব পালন করে এসেছেন। একে বিতর্কিত করার কোন অবকাশ নেই।
অথচ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামের মধ্যে ধর্মীয় বিদ্বেষ খোজার চেষ্টা করা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপচেষ্টারই নামান্তর। আর তাদেরকে প্রশ্রয় দিয়ে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে উদাহরণ সৃষ্টি করলেন তা প্রশ্নবিদ্ধ ও নিন্দনীয়।
আদিবাসীদের উপস্থিতি যেমন অন্তর্ভুক্তিমূলক কাজের অংশ তেমনি তাদের আদিবাসী পরিচয়ের অস্বীকৃতি তাদের প্রতি সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অবহেলারই নজিরমাত্র।
আমরা মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী বাংলাভাষাভাষীরা যে সময় বাংলা নববর্ষ পালন করি, একই সময় জুড়ে বিভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বিজু, সাংগ্রাইং, বৈসু, বিহু, বিষু, চানক্রান, সাংলান, সাংগ্রাই প্রভৃতি উৎসব নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালন করে থাকেন।
তাই এই পয়লা বৈশাখকে ঘিরে যে সকল সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উৎসব হয় তা আমাদের জাতীয় ঐক্য ও সংহতি প্রকাশের এক মহা আয়োজনও বটে। এই আয়োজনকে কলঙ্কিত বা বাধাগ্রস্ত করার কোন আধিকার কারো নেই।
ইতিমধ্যে উগ্রসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এবং অন্যান্য মহলের উস্কানিমূলক বক্তব্যে উদ্বেগ জানিয়ে জাতীয় কবিতা পরিষদ সংবাদ সম্মেলন করে তার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা ৫ দফা দাবিও জানিয়েছেন। তাদের ঐসকল দাবির প্রতিও আমরা দৃঢ় সমর্থন ও সংহতি জ্ঞাপন করছি।”
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন-
সুলতানা কামাল, মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা,
খুশী কবির, সমন্বয়কারী, নিজেরা করি,
ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি, শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি,
ড. পারভীন হাসান, ভাইস চ্যান্সেলর, সেন্ট্রাল উইম্যান ইউনিভার্সিটি, ড. সামিনা লুৎফা, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ড. জোবাইদা নাসরীন, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ড. খাইরুল চৌধুরী, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তাসনীম সিরাজ মাহবুব, সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,
জেড আই খান পান্না, সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও চেয়ারপার্সন, আসক, অ্যাড. সুব্রত চৌধুরী, সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, অ্যাড. তবারক হোসেইন আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট,
পাভেল পার্থ, লেখক ও গবেষক, রেজাউল করিম চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক, কোস্ট ট্রাস্ট, মনিন্দ্র কুমার নাথ, ভারপ্রাপ্ত সা্ধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, অ্যাড. মিনহাজুল হক চৌধুরী, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, সাঈদ আহমেদ, মানবাধিকার কর্মী, হানা শামস আহমেদ, আদিবাসী অধিকার কর্মী।
//এল//