
ছবি: উইমেনআই২৪ ডটকম
বিশ্বে প্রতি ৪ জন শিশুর মধ্যে ১ জন শিশু বেড়ে উঠছে জন্ম নিবন্ধন ছাড়া। ৬০ শতাংশ মানুষের বিশ্বে কোনো মৃত্যু সনদ নেই। গণযোগাযোগ মাধ্যম জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের সচেতনতা বৃদ্ধি, আইনি কাঠামো এবং নীতিগত সংস্কারের পক্ষে সোচ্চারে ভূমিকা রাখতে পারে।
বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) নারী মৈত্রীর আয়োজনে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে ফারস হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন এবং সিভিল রেজিস্ট্রেশন ও ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস (সিআরভিএস) বিষয়ক কর্মশালায় বিশিষ্টজনেরা একথা বলেন।
সূচনা বক্তব্য দেন নারী মৈত্রীর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আক্তার ডলি। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, গ্লোবাল হেলথ এডভোকেসি ইনকিউবেটরের বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস। একটি বিশেষ অধিবেশনে বক্তব্য দেন ভাইটাল স্ট্রাটেজিস, বাংলাদেশের কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর নজরুল ইসলাম।
নারী মৈত্রীর প্রকল্প ব্যবস্থাপক লায়লা আরিফা খানম এবং সিনিয়র অ্যাডভোকেসি অফিসার আনিকা আনজুম ঐশী, সিআরভিএস এবং এর সামাজিক উন্নয়নে প্রভাব সম্পর্কে ধারণা দেন।
নারী মৈত্রীর প্রোগ্রাম পরিচালক খালেদ বিন ইউসুফের সঞ্চালনায় সিআরভিএস শক্তিশালী করতে মিডিয়ার ভূমিকা শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর বাংলাদেশের কান্ট্রি লিড মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস,ভাইটাল স্ট্রাটেজিস, বাংলাদেশের কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর মো. মঈন উদ্দিন, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরিফ-উজ-জামান খান, দৈনিক কালবেলার স্বাস্থ্য সম্পাদক ও বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি এম এম রাশেদ রাব্বী।
গল্প বলার শক্তি তুলে ধরেন দুই কমিউনিটি সদস্য, মোসা. উম্মে সালমা এবং লিয়ন রিছিল। কর্মশালায় ব্রেইন স্টর্মিং পর্ব পরিচালনা করেন চ্যানেল আই এর সিনিয়র নিউজ এডিটর এবং সমষ্টির নির্বাহী পরিচালক মীর মসরুর জামান।
বাংলাদেশে সিআরভিএস শক্তিশালীকরণে গণযোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা বিষয়ক তথ্য প্রচার এবং জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের প্রভাবশালী গল্প সাংবাদিকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এই কর্মশালার আয়োজন।
শাহীন আক্তার ডলি বলেন, বাংলাদেশের সিআরভিএস ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর এর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন।
মূল প্রবন্ধে মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস বাংলাদেশের মিডিয়া কাভারেজ ও সিআরভিএসের অ্যাডভোকেসির বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেন। তিনি মিডিয়ার নীতিগত সংস্কারের ওপর প্রভাব বিস্তারের গুরুত্ব উল্লেখ করে কিছু সফল উদাহরণও তুলে ধরেন।
লায়লা আরিফা খানম এবং আনিকা আনজুম ঐশী, সিআরভিএস এবং এর সামাজিক উন্নয়নে প্রভাব সম্পর্কে ধারণা দেন, যেখানে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়।
নজরুল ইসলাম, সাম্প্রতিক সিআরভিএসের সংস্কার এবং চলমান সরকারি উদ্যোগ সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, দেশে এতো দেরিতে জন্মনিবন্ধন কেনো হচ্ছে, জাস্টিন ট্রুডোকেও রেজিষ্ট্রেশন করে দেওয়া হয়েছে - এই বিষয়গুলো নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করা যেতে পারে। একদিকে যেমন নিবন্ধকের সচেতনতার অভাব রয়েছে। তেমনি পৌর মেয়র, সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব জন্মনিবন্ধনের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করা৷ আর জনগণের দায়িত্ব সময়মতো জন্মনিবন্ধন করা।
তিনি সরকারি সংস্থা এবং গণমাধ্যম সংস্থার মধ্যে আরও সুসংগঠিত সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন, যাতে জনগণের জন্য সিআরভিএস পরিষেবার সহজলভ্যতা বৃদ্ধি পায়।
এম এম রাশেদ রাব্বী বলেন, জন্মনিবন্ধন সঠিক সময়ে না হওয়ার তিনটি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। প্রথম প্রতিবন্ধকতা সর্বস্তরের মানুষের জানার প্রতিবন্ধকতা, দ্বিতীয় জনগণকে জানানোর জন্য সরকারের যে উদ্যোগ সেটি যথাযথ ছিল না, এখনো যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তৃতীয় সরকারের পক্ষ থেকে হঠাৎ করেই দেশে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা গ্রহণের জন্য জন্মনিবন্ধনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু এজন্য যে প্রস্তুতি দরকার ছিল, সাধারণ জনগণকে সেই প্রস্তুতির সুযোগ দেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, সিআরভিএস সম্পর্কে জনসাধারণের সচেতনতার অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করলেও পর্যাপ্ত প্রচার না থাকায় সাধারণ জনগণ বিভ্রান্তির সম্মুখীন হচ্ছেন।
আরিফ-উজ-জামান খান সিআরভিএস ব্যবস্থার স্বচ্ছতার ওপর জোর দেন এবং অভিভাবকদের ভুয়া জন্ম নিবন্ধন বা ভুল জন্ম তারিখ ব্যবহারের প্রবণতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান।
এছাড়াও তিনি উল্লেখ করেন , গ্রামীণ নারীরা প্রায়শই তাঁদের প্রকৃত বয়স গোপন করেন, যা যথাযথ চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে।
মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ এবং সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা নেওয়া উচিত। তিনি উল্লেখ করেন, ইউনেস্কাপ, সিভিআরএস ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারে।
মো. মঈন উদ্দিন সিআরভিএস ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে জনগণের স্বচ্ছতা এবং সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ সিআরভিএস ব্যবস্থার কার্যকারিতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মীর মসরুর জামান অংশগ্রহণকারী মিডিয়া অ্যাডভোকেসির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা এবং সহযোগিতার উপায় নিয়ে আলোচনা করেন।
লিয়ন রিছিল, সিআরভিএস বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও সফলতার বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। মিডিয়ার মাধ্যমে মানবিক গল্প প্রকাশের গুরুত্বকে পুনর্ব্যক্ত করে।
সাংবাদিকদের তিনটি দলে বিভক্ত করা হয়। তারা সিআরভিএস প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ করেন।
প্রথম দল লিয়ন রিছিলের অভিজ্ঞতা প্রচারের সুপারিশ করে, বিশেষ করে বাংলাদেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে সিআরভিএস ব্যবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য।
দ্বিতীয় দল উম্মে সালমার অভিজ্ঞতা অধিকতর প্রচারের পরামর্শ দেয় এবং রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে নীতিগত সংস্কারের জরুরি বিষয়গুলি তুলে ধরার প্রস্তাব করে।
তৃতীয় দল বিদেশগামী নারী শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে, যারা ভুয়া জন্ম নিবন্ধনের কারণে বিদেশে সহিংসতা ও বৈষম্যের শিকার হয়ে বিদেশেই মৃত্যুবরণ করেন। তারা সেইসব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরির পরিকল্পনা করেন।
কর্মশালা সমাপনী বক্তব্যে খালেদ বিন ইউসুফ সিআরভিএস রিপোর্টিং ও অ্যাডভোকেসি জোরদার করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন এবং মিডিয়া ও অংশীজনদের মধ্যে অব্যাহত সহযোগিতার আহ্বান জানান। যা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়ক হবে।