
ছবি: উইমেনআই২৪ ডটকম
ইন্টারনেট ও স্মার্ট ফোনের ব্যবহার বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে নারীর শিক্ষা ও কাজের পরিধি। এ পরিসরে অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে সাইবার জগতে নারীর সরব উপস্থিতি যেমন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, পাশাপাশি অনলাইনে নারীদের প্রতি হয়রানি ও সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো বাস্তব দুনিয়ায় যেমন নারীরা সহিংসতার শিকার হন, তেমনি নারীরা ইন্টারনেট কম ব্যবহার করলেও সহিংসতার চিত্র নেট দুনিয়াতেও প্রায় একই রকম। নেট দুনিয়ায় সংঘটিত নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনার আর একটি ভয়ানক দিক হলো এটি অনলাইনে হলেও এর প্রভাব বাস্তব জীবনেও মারাত্বক আকার ধারণ করে। যার মধ্যে সামাজিক, শারীরিক, আর্থিক ও মানসিক ক্ষতি ছাড়াও রয়েছে নারী ও শিশুর আত্মহত্যা। আর শুধুমাত্র লিঙ্গের কারণে পুরুষ দ্বারা তাদেরকে হত্যা করা। অনলাইনে সহিংসতার ঘটনা অহরহ ঘটলেও ডিজিটাল শিক্ষা, নীতি ও সচেতেনতার অভাব, যথাযথ আইনি কাঠামো, সামাজিক প্রথা ও মনস্তত্ব এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি নারীকে প্রতিকার পাওয়া থেকে দূরে রাখছে।
রবিবার ( ৯ মাচ) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এর আয়োজনে
ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে নারীর প্রতি সহিংসতা: চ্যালেঞ্জ এবং করণীয় শীর্ষক মুক্ত আলোচনায় বক্তারা একথা বলেন।
আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক। এছাড়া আলোচনায় অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধা সাঈদা কামাল, ওমেন্স উইন্ডোজ এর এন আর মুশফিকা লাইজু, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইডের অফিসার শৌমিক শরিফ শাওন, সমকালের জেষ্ঠ সাংবাদিক সাইফুর রহমান তপন, বি এন এন আর সির প্রতিভা ব্যানার্জী, প্রেরণার শম্পা গোস্বামী, নারীপক্ষের ফেরদৌসী আখতার, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তাহসীনা রুমা, হ্রদি। মুক্ত আলোচনা সঞ্চালনা করেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের নাহিদ শামস।
নারীর প্রতি সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধে কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
নারীর প্রতি সাইবার সহিংসতায় সুরাহার পথ তিনটি। প্রথমটি আইনি ব্যবস্থায় জোরারোপ। দ্বিতীয়টি সমাজ মনস্তত্ত্বের পরিবর্তন সাধন এবং তৃতীয়ত মানবাধিকার সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো।
অনলাইনে হয়রানির শিকার হলে অভিযোগ করায় বিষয়টি সহজে ও নারীবান্ধব করা। এক্ষেত্রে সহজে ব্যবহার করা যায় এমন মোরাইল অ্যাপস তৈরি করতে হবে সহজে অভিযোগ দাখিলের জন্য। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
তথ্য প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বিষয়ে নারীদের পড়াশোনার সুযোগ বাড়ানো। যেসব আইন এখন অবধি প্রণীত হয়েছে তাদের কার্যকারিতা এবং কোথায় কোথায় সমস্যা এ বিষয়ে গবেষণা প্রয়োজন। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে যৌন হয়রানি ও অনলাইন নিরাপত্তা বিষয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকদের জানানো প্রয়োজন।
ভুয়া আইডি শনাক্তকরণ এবং সেসব বাতিল করতে পারলে সাইবার অপরাধ অনেকটাই কমতে পারে। টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন বাধ্যতামূলক করতে হবে।
সাইবার অপরাধীদের নিরুৎসাহিত করার জন্য সাইবার ব্যবহারকারীদের গাইডলাইন প্রণয়ন করতে হবে। যেখানে কী করা যাবে এবং কী করা যাবে না তার পরিষ্কার নির্দেশনা থাকবে।
ডিজিটাল লিটারেসি ও এথিক্স এর কোন বিকল্প নেই। ফলে ডিজিটাল লিটারেসি ট্রেনিং এবং ডিজিটাল সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়ানো। এ বিষয়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষা কার্যক্রমের সিলেবাসেও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারীর প্রতি সাইবার অপরাধ কমানোর জন্য যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাদের অভিজ্ঞতা জেনে, তাদের ভালো প্র্যাকটিসগুলো আমাদের দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আমাদের কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যও গবেষণা করা।
জেন্ডার বিভক্ত বাংলাদেশের সমাজে নারী ও কন্যাদের প্রতি সাইবার অপরাধ কমানো। দেশের সার্বিক নারী ও কন্যাদের মানবিক মর্যাদায় উন্নীত করার বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। এ কাজটি বহুস্তরভিত্তিক এবং এর জন্য রাষ্ট্রের কমিটমেন্ট প্রয়োজন। প্রয়োজন যথাযথ বিনিয়োগ বুদ্ধিবৃত্তিক এবং অর্থনৈতিক।
আসন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রযুক্তির ব্যবহারে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ এবং কিশোর- তরুণ অপরাধী গ্যাং প্রতিপালনের সংস্কৃতি পরিবর্তনে পরিকল্পনা কী সেই মর্মে লিখিত প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। অপরাধ সংগঠিত হয় প্রথমে সাংস্কৃতিক মননে। কিশোর ছেলেরা আগে এলাকার মেয়েদের দিকে শিস ছুঁড়ে দিতে দিতে পুরুষ হয়ে ওঠতো। সমাজে এ ব্যবহারের প্রশ্রয় ছিল। এখন সেই শিস দেয়া মন সাইবার পরিসরে নিজেদের নিয়োজিত করছে। এ মনকে কেবল আইনি কাঠামো বা প্রাযুক্তিক শনাক্তকরণের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন করা যাবে না। এর জন্য মনোজগতে পরিবর্তন প্রয়োজন। এ কাজটি সবচেয়ে কঠিন। এক্ষেত্রে পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
প্রবন্ধে আরো বলা হয়, গতবছর সংঘটিত জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নারীদের অংশগ্রহণ যেমন সরব ছিল, তেমনি অনলাইনে হয়রানিরও শিকার হয়েছেন অনেক নারী। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা নারীদের জন্য এমন একটি নিরাপদ ডিজিটাল পরিবেশ গড়ে তুলতে চাই যেখানে নারী শিকার হবে না, কোনো ধরণের সহিংসতার, আপন প্রতিভার আলোয় নিজেকে এবং দেশকে করবে আলোকিত।
ড. তানিয়া হক বলেন, নারীর উন্নয়ন যতখানি হয়েছে, ক্ষমতায়নের জায়গাটি এখনো অনেক দুবল। টেকসই উপায়ে ক্ষমতায়নকে এখনো নিশ্চিত করতে পারছি না। এর প্রধান কারণ নারীর প্রতি সহিংসতা, ঘর থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের কাছে দিবসটিকে কেন্দ্র করে একটি অভিন্ন পৃথিবী তৈরির প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, নারীর পাশাপাশি পুরুষ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, হিজড়া জনগোষ্ঠী সকলে যেন একটি সমতার পৃথিবীর স্বাদ পায়। কিন্তু সব সময় দেখছি, সহিংসতার শিকার হচ্ছে নারী। ফুটবলার সুমাইয়ার ঘটনায় দেখেছি, সহিংসতার শিকার হয়েও সমঝোতা করে নিয়েছে। সহিংসতা হয় এই কারণে সহিংসতাকে গ্রহণ করি, সহিংসতাকে প্রত্যাখ্যান করার বুদ্ধিটাকে বিলুপ্ত করে রেখেছি।
এন আর মুশফিকা লাইজু জানান, নারী এক্টিভিস্টরা হতাশ ছাড়া আর কিছু দেখাতে পারছে না। শুধুই অন্ধকার।
সাইফুর রহমান তপন বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় রোকেয়া হলের মেয়েরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে প্রতিবাদ করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছে কয়েকটি দাবি জানিয়েছে। প্রক্টরকে তারা বলেছে যে ছেলেটি ওড়না কান্ড করেছে তাকে যদি চাকরিতে বহাল রাখা হয় তাহলে আমরা যে কোনো কিছু করতে পারি।
ইউ