
ফাইল ছবি
বাংলাদেশে কিশোরী মেয়েদের অগ্রগতিতে ধীরগতি। এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ শিশুবিয়ের হার বেশি বাংলাদেশে।
কিশোরী বয়সী মেয়েদের ক্ষমতায়নে বিনিয়োগ ও নীতি পরিবর্তনের জরুরি প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত ইউনিসেফ, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও ইউএন উইমেনের একটি বৈশ্বিক প্রতিবেদনে। এছাড়া , প্রতিবেদনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:
কিশোরী মেয়েদের বক্তব্যকে সবার সামনে তুলে ধরা এবং তাদের অ্যাডভোকেসিকে সহায়তা করা। শিক্ষা, দক্ষতা ও প্রশিক্ষণে বিশেষ করে ডিজিটাল শিক্ষায় যে ঘাটতি রয়েছে, তা দূর করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে কিশোরী মেয়েদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনের বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলো পূরণে বিনিয়োগ করা। এক্ষেত্রে তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ওপর গুরুত্ব দেয়া।
শনিবার (৮ মার্চ) আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ইউনিসেফ, ইউএন উইমেন ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল দ্বারা প্রকাশিত গার্লস গোলস: হোয়াট হ্যাজ চেঞ্জড ফর গার্লস? অ্যাডোলেসেন্ট গার্লস রাইটস ওভার ৩০ ইয়ার্স শীর্ষক প্রতিবেদনে বিভিন্ন কমিউনিটির কথা তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যারা মেয়ে বিশেষ করে কিশোরী মেয়েদের বিকাশের জন্য বিনিয়োগ করে নানানভাবে উপকৃত হয়েছে। এতে দেখান হয়েছে, এই বিনিয়োগের সুফল কেবল ব্যাক্তিগত বা পারিবারিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিলো না বরং তা কমিউনিটি ও দেশগুলোর স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ও অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ব্যাপক ভুমিকা রেখেছে। প্রতিবেদনে প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল বৃদ্ধির মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্জিত উন্নয়নের বিষয় উঠে আসলেও তাতে বাংলাদেশের কিশোরী মেয়েদের ওপর বিশেষ মনোযোগ দেবার কথা বলা হয়েছে, যেখানে কিশোরীদের এখনো প্রতিনিয়িত বৈষম্য, সহিংসতা, শিশুবিয়ে, শিক্ষার সুযোগের ঘাটতি এবং সুযোগ স্বল্পতার সাথে লড়াই করতে হচ্ছে।
১৯৯৯ বেইজিং ঘোষণায় যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছিল, ৩০ বছর পরে এসে সেসব অঙ্গীকার বাস্তবায়নে দেশগুলো কতটা অগ্রগতি অর্জন করেছে, তার পর্যালোচনা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে পরিশেষে বলা হয়েছে যে মেয়েদের জন্য অনেক ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। শিক্ষায় বিনিয়োগের সুফল এসেছে, মেয়েদের স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও উন্নতি হয়েছে। এখন কন্যাশিশুরা আগের তুলনায় তেমন একটা শিশুবিবাহের শিকার হয় না কিন্তু বাংলাদেশের মতো বিভিন্ন দেশ এখনো এই ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে। বাংলাদেশে ৫০ শতাংশের বেশি কন্যাশিশু এই ক্ষতিকর চর্চার শিকার হচ্ছে, শিশুবিবাহের এই হার এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
কিশোরী মেয়েদের জন্য বিনিয়োগের ফলে তার সুফল ওই কিশোরী মেয়ের পাশাপাশি ভোগ করে তার কমিউনিটি ও দেশ — এর বিপুল তথ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে কিশোরী মেয়েরা তাদের সমবয়সী ছেলেদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে সঠিক বিনিয়োগের অভাবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সমবয়সী ছেলেদের তুলনায় ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী কিশোরী মেয়ে ও তরুণ নারীদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের সুযোগ না পাওয়ার সংখ্যা এখনো দ্বিগুণ এবং স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে তাদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই ইন্টারনেট সুবিধা পায় না।
প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উদ্বেগ জানানো হয়েছে যে, কোনো দেশই কিশোরী বয়সী মেয়েদের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ১৬টি এসডিজি লক্ষ্যের অর্ধেকও পূরণ করতে পারেনি। সেকারণে ২০৩০ এসডিজি এজেন্ডা অর্জনের জন্য আর মাত্র পাঁচ বছর বাকি থাকায় এক্ষেত্রে নতুন করে গুরুত্ব আরোপ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
“বাংলাদেশে কিশোরী মেয়েরা একটি অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে চায়, যেখানে তারা নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা পাবে এবং দেশের উন্নতিতে সহযোগিতা করতে পারবে। তা সত্ত্বেও নানা প্রতিবন্ধকতা ও বৈষম্য তাদেরকে আটকে রাখছে এবং তাদের দেশও এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জীবন দক্ষতা ও ডিজিটাল শিক্ষা অর্জনের সুযোগ নিশ্চিত করা যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি উচ্চ হারে বিদ্যমান শিশুবিয়ে এবং কন্যাশিশু ও নারীদের ওপর সহিংসতা মোকাবিলা করা; কেননা এর ফলে অল্প বয়সে ও বিপজ্জনকভাবে সন্তানধারণের ঘটনা ঘটে এবং প্রায়ই প্রান হারায় ছোট্ট-বয়সী মা ও তার সন্তান,” বলেছেন বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স।
তিনি আরও বলেন, ‘এই আন্তর্জাতিক নারী দিবস সব বাধা দূর করে সবার জন্য সমান সুযোগ ও আশার সঞ্চার করুক। আমাদের অবশ্যই কন্যাশিশু তথা মেয়েদের বক্তব্য তুলে ধরতে হবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে পরিবর্তনের জন্য এখন গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়, তরুণ নারী ও পুরুষেরা আরও ভালো একটি ভবিষ্যত গড়ার ডাক দিয়েছে- তাদের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা সরকারের প্রতি কিশোরীদের স্বাস্থ্য সেবা, সমাজকর্মী বা সমাজকল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত জনবল আরও শক্তিশালী করা, শিক্ষা ও পুষ্টিতে বিনিয়োগ করা এবং সব মেয়েদের জন্য জীবন দক্ষতা অর্জন ও ডিজিটাল শিক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি শিশুবিয়ে রয়েছে, সেসব দেশের তালিকায় অষ্টম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। আর শিশুবিয়ের দিক থেকে এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সবার উপরে।১ বাংলাদেশে ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৫১ দশমিক ৪ শতাংশেরই বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর হওয়ার আগে২। এর ফলে কন্যাশিশু তথা মেয়েদের স্থায়ী দারিদ্র্যের চক্রে আটকে যেতে দেখা যায়, তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয়, তাদের সম্ভাবনার বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয় এবং মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক ঝুঁকিতে থাকায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে শিশুবিয়ে ও অল্প বয়সে সন্তানধারণের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে ২০-২৪ বছর নারীদের মধ্যে ২৪ শতাংশ নারী ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। তাছাড়া বাংলাদেশে ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরী মেয়েদের ২৮ শতাংশ বিগত ১২ মাসের মধ্যে তাদের সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে। আর ১৫-১৯ বছর বয়সী বিবাহিত কিশোরী মেয়েদের মধ্যে মাত্র ৪৭ শতাংশ জেনেবুঝে প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
‘বেইজিং ঘোষণার ৩০ বছর পূর্তির সঙ্গে সঙ্গে আমরা নারী ও কন্যাশিশুদের অধিকার নিশ্চিতকরণে অগ্রগতিও উদযাপন করছি। তবে এই অগ্রগতি অর্জনের ধারা যে ধীরগতিসম্পন্ন, অমজবুত ও অস্থিতিশীল তাও স্বীকার করে নিচ্ছি। বাংলাদেশে এখনো অনেক কন্যাশিশু স্কুলে যায়না, তারা ক্ষতিকর চর্চা ও সহিংসতার ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের সম্ভাবনার বিকাশের জন্য অল-হ্যান্ডস-অন-ডেক এপ্রোচ অর্থাৎ এখন থেকেই সবাই মিলে কাজ করার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসা আবশ্যক। তাদের ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্বের দক্ষতা তৈরির জন্য বিনিয়োগ করাটা কেবল সঠিক নয় বরং একটি স্মার্ট পদক্ষেপও বটে,’ বলেছেন বাংলাদেশে ইউএন উইমেনের প্রতিনিধি গীতাঞ্জলি সিং।
বাংলাদেশে কিশোরী কন্যাশিশুদের মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়া সম্পন্ন করার হার ৫৯ দশমিক ২২ শতাংশ৪। প্রতিবেদনে কিশোরী মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে ২০৩০ এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে সরকার ও সব অংশীজনদের উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিশ্বে যে সাতটি দেশে কিশোরী মেয়ে ও তরুণ নারীদের ডিজিটাল দক্ষতার হার ২ শতাংশ বা তার চেয়ে কম সে সব দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ।
“এটা দেখে আমি খুব খুশি যে বাংলাদেশ কিশোরী মেয়েদের সন্তান জন্মদানের হার কমানো, সন্তান জন্মের সময় দক্ষ সেবাদাত্রীর উপস্থিতি বৃদ্ধি এবং মেয়ে ও তরুণ নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য বড় ধরনের প্রচেষ্টা নিয়েছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়েদের অন্তর্ভুক্তি ও তাদের এসব পর্যায়ের শিক্ষা সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে উন্নতিও দৃশ্যমান,” বলেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর কবিতা বোস।
তিনি আরো বলেন, ‘অবশ্য শিক্ষার গুণগত মান এখনো একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে। ডিজিটাল দক্ষতার ক্ষেত্রে কন্যাশিশু ও তরুণ নারীরা উদ্বেগজনকভাবে পিছিয়ে রয়েছে। শিশুবিয়ে, অল্পবয়সে ও জোরপূর্বক বিয়ের হার কমানো, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি এবং কিশোরীদের অধিকার নিশ্চিতকরণ ও জ্নপরিসরে মেয়েদের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এখনো অনেক কিছু করার রয়েছে। আমরা সবাই সমান না হওয়ার আগ পর্যন্ত অল গার্লস স্ট্যান্ডিং স্ট্রং ক্রিয়েটিং গ্লোবাল চেঞ্জ (সকল মেয়েদের নিজ পায়ে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে গোটা বিশ্বে পরিবর্তন আনার জন্য প্রস্তুত করার) এর লক্ষ্য নিয়ে কন্যাশিশু ও তরুণ নারীদের ক্ষমতায়নে কাজ করছে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল।’
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, অনেক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বৈশ্বিকভাবে ১৫ বছর বয়সী কিশোরীদের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল বেড়ে ৭৯ দশমকি ১ বছর হয়েছে ( সাড়ে ৪ বছর বেড়েছে), এটা মেয়েদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতে অগ্রগতিকেই তুলে ধরেছে। এক্ষেত্রে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) টিকা প্রদানের মতো নতুন নতুন ক্যাম্পেইনের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশজুড়ে লাখ লাখ কন্যাশিশুর স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ আরও সুরক্ষিত হয়েছে জরায়ু ক্যানসারের বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়ার মধ্য দিয়ে। জরায়ু ক্যানসারে প্রতি বছর বাংলাদেশে হাজার হাজার নারীর মৃত্যু হয়ে থাকে। ইউনিসেফ ২০২৩-২৪ সালে একটি সফল এইচপিভি টিকা ক্যাম্পেইন সম্পন্ন করতে সহায়তা করেছিল। তখন সারা দেশে টিকা পাওয়ার মতো কন্যাশিশুদের মধ্যে ৯৩ শতাংশকে গুরুত্বপূর্ণ এই টিকা দেয়া হয়েছিল।
ইউ