ছবি: উইমেনআই২৪ ডটকম
সরকারি চিনিকলগুলোর লোকসানের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান ও দায়ীদের চিহ্নিত করার জন্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে তদন্ত কমিশন গঠন, ২০১৬ সালে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লিতে তিনজনকে হত্যা, লুটপাট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদসহ জড়িতদের দ্রুত বিচার ও শাস্তি এবং রংপুর চিনিকলের আখচাষের জন্য রিকুইজিশন করা সাঁওতালদের পূর্বপুরুষদের জমি ফেরত প্রদানসহ সাত দফা দাবি জানিয়েছে ১০ মানবাধিকার ও নাগরিক সংগঠনের প্লাটফরম ‘জাতীয় নাগরিক সমন্বয় কমিটি’।
রবিবার (২৯ ডিসেম্বর) সকালে রাজধানীর রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে রংপুর চিনিকল চালু করার নামে গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল আদিবাসীদের ভূমি কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে এ সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি তুলে ধরা হয়। কমিটির অন্তর্ভুক্ত সংস্থাগুলো হলো- এএলআরডি, নিজেরা করি, ব্লাস্ট, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ আন্দোলন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি।
নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবিরের সঞ্চালনায় আয়োজকদের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন এএলআরডি-র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।
লিখিত বক্তব্যে শামসুল হুদা বলেন, বর্তমানে দেশে সরকারি চিনিকলের সংখ্যা ১৫টি, যার মধ্যে ৩টি ব্রিটিশ আমলে, ৯টি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে এবং ৩টি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্থাপিত হয়েছে। তবে এই ১৫টির মধ্যে চালু আছে ৯টি, ‘আখের সংকট ও লোকসান’-এর কারণ দেখিয়ে কয়েক বছর আগে বাকিগুলো বন্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা সরকারের পক্ষ দেয়া হয়। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের অধীন এসব সরকারি চিনিকল ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৬ বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে সরকারি চিনিকলগুলোর বিপুল এ লোকসানের মূল কারণ চিনিকল কর্তৃপক্ষের অবহেলা, অব্যবস্থাপনা, পুরোনো যন্ত্রপাতি এবং সর্বোপরি নানা গোষ্ঠীর মিলিত লুণ্ঠন। সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীসমূহের লুণ্ঠনের আংশিক চিত্র রাষ্ট্রীয় (সিএজি’র) অডিট রিপোর্টে দৃশ্যমান।
তিনি আরো বলেন, প্রতিবছর লোকসানের শিকার হয়ে সরকারি চিনিকলগুলো কৃষকদের আখ চাষে উৎসাহিত করতে পারছে না অন্যদিকে সময়মত শ্রমিকদের মজুরি-ভাতা প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে। উৎপাদিত চিনির দাম বাজারের চেয়ে অনেক বেশি হবার কারণে বিক্রিও হয়না, সেগুলো গুদামে পড়ে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে বন্ধ হওয়া চিনিকল চালুর সিদ্ধান্তের কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। আখচাষী আর চিনিকল শ্রমিকদের স্বার্থের কথা বলে একটি চক্রের অর্থ লোপাটের পাঁয়তারা ছাড়া এ বিষয়টিকে তাই অন্য কোনোভাবে দেখার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কৃষি ও কৃষকদের কথা চিন্তা করে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প বিকাশের জন্য চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের সংস্কার করে এর জনকাঠামো ঢেলে সাজাবে, কর্পোরেশনের দুর্নীতিবাজ ও লুণ্ঠনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ চিনিকলগুলো থেকে অর্থলোপাটকারী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনবে। কিন্তু আমরা দেখলাম সেটি সম্পন্ন না করে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেবার মতো করে বন্ধ হয়ে যাওয়া চিনিকলগুলো চালুর ঘোষণা দিয়ে বিগত স্বৈরশাসকদের সুবিধাভোগী লুণ্ঠনকারীদের নতুনভাবে অর্থলোপাটের আরো সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। আমরা অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা চিনিকলের বা চিনির দেশীয় উৎপাদনের বিরুদ্ধে নই কিন্তু বর্তমানে বন্ধ সব চিনিকল চালু করলেও দেশে মোট চাহিদার মাত্র ৫ শতাংশ পূরণ হবে, বাকি ৯৫ শতাংশ বাইরে থেকে মূলত আমদানিই করতে হবে। তাহলে বন্ধ চিনিকলগুলোকে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে চালু করে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের সুবিধা করে দেবার কোনো মানে হয় না। বরং সেই অর্থ কৃষি নির্ভর খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প বিকাশের কাজে ব্যয় করা যেতে পারে, কৃষিকাজের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, যেখানে চালু থাকা চিনিকলগুলোই বিপুল অর্থের লোকসান দিচ্ছে, চিনি বিক্রি করতে ব্যর্থ হচ্ছে তাহলে বন্ধ চিনিকলগুলো কেন চালু করা হচ্ছে? চালু করা হচ্ছে যাতে আরো লোকসান দেখিয়ে জনগণের টাকা কিছু লোক ভাগবাটোয়ারা করে নিতে পারে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মের তিন-চার ফসলি জমিতে যারা চাষাবাদ করছেন, তারা জাতিগত ও ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু বলে দুর্বল অবস্থানে আছেন, তাদের জমি কেড়ে নেয়া সহজ। আট বছর আগে আগুন দিয়ে বাগদা ফার্মের আদিবাসীদের বাড়িঘড় যারা পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে, তিনজনকে হত্যা করেছে তাদের বিচার হয়নি।
তিনি আরো বলেন, বর্তমান বিশ্বের যে মন্দা দেখা দিয়েছে তাতে খাদ্য নিরাপত্তায় দেশীয় খাদ্যের উৎপাদন ঠিক রাখতে হবে। কারখানার অজুহাতে কৃষিজমি-জলাভূমি-বন ধ্বংস করতে দেয়া যাবে না।
সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে খুশী কবির বলেন, আমরা সার্বিক চিত্রটি দেখতে চাই, কোনটা বেশি জরুরি? চিনিকল নাকি অন্য কোনো ফসল। অনেক বছর ধরে চিনিকলগুলো অকার্যকর, সেগুলো জমি দখল করে রেখেছে। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি বিষয়টি দেখার জন্য। তবে এখনই আমরা কোনো আইনী পদক্ষেপের দিকে যাচ্ছি না।
অন্যান্যের মধ্যে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. সুব্রত চৌধুরী, সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. তবারক হোসেইন, ব্লাস্টের পরিচালক ও আইন উপদেষ্টা অ্যাড. এসএম রেজাউল করিম, সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি’র সভাপতি ডা. ফিলিমন বাস্কে, আদিবাসী-বাঙ্গালি সংহতি পরিষদ গাইবান্ধার আহ্বায়ক ও গাইবান্ধা আইনজীবী সমিতি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. সিরাজুল ইসলাম বাবু প্রমুখ।
কমিটির সাত দফা দাবি হলো-
১. বন্ধ চিনিকলগুলো চালু করা আদৌ লাভজনক কিনা তার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে উপযুক্ত বিশেষজ্ঞ দল নিয়োগ করে, তাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ও সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় কৃষকসহ অংশীজনদের সাথে আলোচনা করে এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
২. সরকারি চিনিকলগুলোর লোকসানের পেছনের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান ও দায়ীদের চিহ্নিত করার জন্য তথ্যাভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।
৩. উপর্যুক্ত কাজ সম্পন্ন হবার পূর্ব পর্যন্ত বন্ধ চিনিকল চালুর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে হবে।
৪. চিনিকল চালুর জন্য গঠিত দুর্নীতিগ্রস্ত আমলানির্ভর টাস্ক ফোর্স বাতিল করে রুগ্ন, মুমূর্ষ ও দেনার দায়ে জর্জরিত চিনিকলগুলোর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনকে সংস্কার/প্রতিস্থাপন করে দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক চাহিদার নিরিখে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের উন্নয়ন কিভাবে ঘটানো যায় তার প্রস্তাবনার জন্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে।
৫. গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মের রিকুইজিশন করা জমি আখ চাষের নামে নেয়া হলেও বিগত প্রায় দুই দশক ঐ কাজে ব্যবহৃত হয়না। তাই তিন ফসলি ১৮৪২.৩০ একর কৃষিজমি মূল সাঁওতাল আদিবাসী মালিকদের উত্তরাধিকারী ও তাদের পরিবার পরিজন এবং অন্যান্য আদি-বাঙ্গালী কৃষক পরিবারের কাছে অবিলম্বে হস্তান্তর করতে হবে।
৬. ৬ নভেম্বর ২০১৬ সালে সাঁওতাল পল্লীতে হামলাকারী, অগ্নিসংযোগকারী, লুটপাটকারী পুলিশের একাংশসহ অভিযুক্ত সকলকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচার ও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৭. ঐদিন গোবিন্দগঞ্জে শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডুকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এই হত্যার আয়োজনের সাথে স্থানীয় স্বৈরশাসকদের দোসর সাবেক স্থানীয় এমপি আবুল কালাম আজাদ এবং চিনিকল ম্যানেজার আব্দুল আউয়ালের সম্পৃক্ততা ছিল বলে অভিযোগ আছে। অবিলম্বে হত্যাকারীদের গ্রেফতার এবং আইন অনুযায়ী দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
ইউ