সংগৃহীত ছবি
দক্ষিণ এশিয়ার মেগাসিটিগুলো যেমন ঢাকা, দিল্লি, মুম্বাই, করাচি, লাহোর, কোলকাতা প্রভৃতি দ্রুত নগরায়নের ফলে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো ও অন্যান্য প্রকল্পের কারণে এসব নগর এলাকায় খোলা জায়গা কমে যাচ্ছে, কমিউনিটি স্পেস হারিয়ে যাচ্ছে, দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের লোকদের নাগরিক সুবিধাদি ও পরিসেবা প্রাপ্তি আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
পাশ্চাত্যের নগর পরিকল্পনার অন্ধ অনুকরণ নয়, বরং জনগণের সম্পৃক্ততা ও কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে এবং এই এলাকার পরিবেশ, সমাজ, কমিউনিটি, স্থাপত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে সুষ্ঠু নগর পরিকল্পনা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার নগর এলাকাসমূহের বাসযোগ্যতা বাড়ানো সম্ভব।
এই লক্ষ্যে পরিকল্পনাবিদসহ বিভিন্ন পেশাজীবী, সমাজচিন্তকসহ নীতি নির্ধারকদের একযোগে কাজ করতে হবে।
শনিবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন উপলক্ষ্যে বিআইপি এবং স্বেচ্ছাসেবী গবেষণাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নলেজিস্ট উইদাউট বর্ডারস' এর আয়োজনে বিআইপি কনফারেন্স হলে হাইব্রিড ফরম্যাটে আয়োজিত "দক্ষিণ এশিয়ার মেগাসিটির পরিবর্তনশীল নির্মিত পরিবেশ" শিরোনামে আন্তর্জাতিক কর্মশালায় দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা উপরোক্ত মতামত ব্যক্ত করেন।
এতে দক্ষিণ এশিয়ার মেগাসিটির পরিবর্তনশীল নির্মিত পরিবেশ নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনায় অংশ নেন শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী, নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, পরিবেশবিদ, গবেষক এবং নীতিনির্ধারকরা। এই কর্মশালার আহবায়ক হিসেবে ছিলেন ড. তাসলিম শাকুর, অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান, এবং স্থপতি ইমামুর হোসাইন।
অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মেগাসিটিগুলোর বাসযোগ্যতা বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদী ও কার্যকর নগর পরিকল্পনার বাস্তবায়ন, টেকসই অবকাঠামো উন্নয়ন, গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন।
বিআইপির সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মেগাসিটিগুলোর নগর পরিকল্পনাগত চ্যালেঞ্জগুলো প্রধানত দ্রুত নগরায়ন, জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপ, অপরিকল্পিত অবকাঠামো, পরিবেশ দূষণ, এবং নাগরিক সুবিধাদি ও পরিসেবার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এগুলোর উত্তরণে স্থানীয় এলাকার বৈশিষ্ট্যসমূহ মাথায় রেখে পরিকল্পনা কৌশল সাজাতে হবে।
নলেজিস্ট উইদাউট বর্ডারস' এর সমন্বয়ক ড. তাসলিম শাকুর বলেন বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন মেগাসিটিতে নগরের দরিদ্র ও প্রান্তিক লোকদের জন্য সাশ্রয়ী ও মানসম্মত আবাসনের উদ্যোগ ছিল খুবই সীমিত। ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় ঢাকা, কলকাতা, দিল্লী, করাচি, লাহোরের মত শহরে একের পর এক মানহীন বস্তি গড়ে উঠেছে। বিআইপি'র সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসান বলেন,কার্যকর পরিকল্পনা, সমন্বিত নীতি, প্রযুক্তির ব্যবহার, এবং জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমাদের নগরগুলোর বাসযোগ্যতা বাড়ানো সম্ভব। এক্ষেত্রে পেশাজীবিদের নগর বাস্তবতাকে মাথায় রেখে কার্যকর কৌশল উদ্ভাবনে জোর দিতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস বিষয়ক গবেষক অনিন্দিতা ঘোষাল বলেন, দেশভাগের পর কলকাতা কিংবা ঢাকায় যারা পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে এসেছেন, তারা নতুন পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় মানিয়ে নেবার চেষ্টা করেছেন। তারপরও তাদের বসত এলাকায় ফেলে আসা দেশের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সেই দেশের ভৌত বৈশিষ্ট্যগুলোর রূপায়ন করবার চেষ্টা করেছেন স্থানান্তরিত শহরে। দিল্লী থেকে স্থপতি নিত্য বালী বলেন, দিল্লী শহরে নগরায়নের চাপে নদীতীর, বন্যা প্রবাহ এলাকাগুলো যথাযথভাবে রক্ষা করা যাচ্ছেনা। হকারের চাপে নগর এলাকার অনেক খোলা পরিসর আর আগের মত ব্যবহার করবার সুযোগ কমে যাচ্ছে। লাহোর থেকে লাহোর কলেজ ফর উইমেন ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক আসিয়া জাবীন বলেন, সড়ক অবকাঠামো প্রকল্পের কারণে লাহোর শহরের গণপরিসর ও খোলা জায়গাগুলো ক্রমান্বয়ে তাদের আবেদন হারিয়ে ফেলছে; শহরের সবুজ এলাকা মারাত্মকভাবে কমে গিয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে নগরে কমিউনিটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক এই কর্মশালায় তিনটি প্রতিপাদ্যের উপর সাজানো আলোচনায় বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান সহ দেশ-বিদেশের আলোচকবৃন্দ অংশ নেন। ইতিহাস ও পরিকল্পনার আন্তঃসম্পর্ক সেশনে কলকাতা, ঢাকা, দিল্লি এবং লাহোরের নগর স্মৃতি, চলাচল এবং শহরের রূপান্তর নিয়ে আলোচনা করা হয়। সমাজ ও অবকাঠামো সেশনে করাচি ও ঢাকার সম্প্রদায়ভিত্তিক মালিকানা, নগর প্রতিবাদ এবং পুনর্বাসন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সেশনে ঢাকাসহ মুম্বাই ও করাচির টেকসই নগর পরিকল্পনা, জলাশয় সংরক্ষণ, এবং নগর পরিবেশের জনস্বাস্থ্য প্রভাব নিয়ে আলোচনা হয়।
এই কর্মশালার মূল আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন প্রফেসর অনিন্দিতা ঘোষাল, নিত্যা বালি, ড. ইয়াসমিন আরা, এশিয়া জাবীন, ফেরদৌস হুসাইন, শিল্পী রায়, আব্দুল্লাহ আহমেদ বাজওয়া, সৈয়দা জাফরিন ন্যান্সি, মিরুন্নালিনী ভেঙ্কটেশ, আব্বা এলিজাবেথ জোসেফ, ড. মিহির হেরলেকার, ড. আয়শা সিদ্দিকা, ড. ফারিদা নিলুফার, আফরোজা বিনতে জামান, ফারহাদুর রেজা, কবিরুল বাশার এবং সানা আর. গণ্ডাল। তাঁরা ইতিহাস, নগর কাঠামো, এবং টেকসই পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে তাঁদের গবেষণা ভিত্তিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
//এল//