উইমেনআই২৪ প্রতিবেদক: এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় কথাসাহিত্যিক নাসরিন জাহানের কবিতার বই 'সমুদ্র আমার একলা জলের নাম’ প্রকাশিত হয়েছে। অনার্য পাবলিকিসন্স থেকে প্রকাশিত এই ক্যব্যগ্রন্থটি নিয়ে উইমেনআই২৪ এর কথা হয় নাসরিন জাহানের সঙ্গে। গল্পে গল্পে উঠে আসে লেখকের ব্যক্তিজীবন এবং সাহিত্যভাবনার বিষয়টি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আইরিন সুলতানা জয়া।
উইমেনআই ২৪ডটকম: এবারের মেলায় আপনার কোন সাহিত্যকর্ম এসেছে কি? বিষয় কি?
নাসরীন জাহান : এবার মেলায় অনার্য পাবলিকিসন্স থেকে আমার কবিতার বই বেরিয়েছে, নাম 'সমুদ্র আমার একলা জলের নাম'। আর প্রায় ২৫ বছর আগে লেখা একটা গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস 'চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার' নতুন করে এনেছে ক্রিয়েটিভ ঢাকা।
উইমেনআই ২৪ ডটকম: আপনি ইদানীং কম লিখছেন। বিশেষ কোন কারণ আছে কি?
নাসরীন জাহান : ইদানীং মোটেই কম লিখছি না। আসলে এতো এতো গদ্য লিখেছি, একঘেয়ে লাগছিলো, তাই প্রচুর কবিতা লিখছি। কবিতা ভূতের মতো আমার মধ্যে চেপে বসেছে।
উইমেনআই ২৪ডটকম: আপনি কৈশোর থেকেই সাহিত্যচর্চার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। সাহিত্যের প্রতি এই যে টান বা আগ্রহ সেটা কিভাবে জন্মাল?
নাসরীন জাহান : শৈশবে প্রথমেই আব্বার প্রভাবে, এরপর শৈশব বন্ধু লেখক পারভীন সুলতানার প্রভাবে। সমান্তরালে চাঁদের হাট করতে করতে তুমুলভাবে লেখার সাথে জড়িয়ে পড়ি। সে এক সময় ছিল, দিনরাত আমরা লেখা নিয়ে কত নীরিক্ষা যে করেছি!
উইমেনআই ২৪ডটকম: আপনার লেখনীতে বারবার মনস্তাত্ত্বিক যে বিষয়গুলো উঠে আসে, সেটা কিসের উপরে ভিত্তি করে? প্রত্যক্ষ নাকি পরোক্ষভাবে সেসব অভিজ্ঞতালব্ধ?
নাসরীন জাহান : আসলে একেকজন লেখকের একেকরকম প্রবণতা থাকে। তার নিজস্ব ফর্ম, ঢঙ অন্য লেখক থেকে তার লেখা কে আলাদা করে। খুব শৈশব থেকেই আমি সবকিছু যেন চোখ দিয়ে নয়, মন দিয়ে দেখতাম। এরপর বিশ্ব সাহিত্যের দরজা খুলে গেলে অনুভব করেছি, ভালো লেখাগুলো মন দিয়ে অনুভব থেকেই সৃষ্ট।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ অবশ্য তার আগে আমার অনুভূতি চর্চার গুরু ছিলেন। আমার জন্য মনস্তাত্ত্বিক লেখা সহজ, আমি প্রচণ্ড ভালোবেসে এর প্রভাবে লিখি।
উইমেনআই ২৪ডটকম: আপনার গল্পগ্রন্থ্যগুলোর জন্য আপনি সবসময়ই বেছে নিয়েছেন চমৎকার সব নাম। এই নাম বাছাইয়ে কি কি বিষয় মাথায় রাখা উচিত একজন লেখকের?
নাসরীন জাহান : এটা সবাই বলে, বইয়ের নামে আমি গুরু ‘হা...হা,’ আসলে আমার লেখায় মনস্তত্ত্বর সাথে কাব্যও থাকে, শুরু থেকেই, প্রতিবাক্যে অবচেতনে একটা ছন্দ একটা রিদম চলতে থাকে......
অনিবার্যভাবে বইয়ের নাম যখন রাখি, লেখার বিষয়টার মিশেলে অদ্ভুত কিছু শব্দ মাথায় ঘুরতে ঘুরতে এক বাক্যের সাথে আরেকটা জুড়ে গিয়ে যখন প্রাণের মধ্যে ঢেউ তোলে,কেমন যেন ম্যাজিকের মতো লাগে, এভাবেই।
উইমেনআই ২৪ডটকম: আপনি দীর্ঘকাল সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। নারী হিসেবে কি কোন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে ?
নাসরীন জাহান : আসলে শুরু থেকেই নারী হিসেবে আমার কোন প্রতিবন্ধকতার স্বীকার হতে হয় নি। লিখতে এসে নিজেকে আমি বোধ থেকেও নিজেকে নারী অনুভব করি নি। স্কুল পড়ুয়া অবস্থাতেই কবি আহসান হাবীব সম্পাদিত দৈনিক বাংলার সাময়িকীতে আমার লেখা ছাপা হয়। অবশ্য একেবারে গোড়াতে এক দুজন সাহিত্য সম্পাদক বলতেন, আমাদের নারী পাতায় লিখুন, অনেক লেখা ছাপা হবে, আমি বলতাম, কেন? আপনাদের সাময়িকী পাতার নাম কি পুরুষ পাতা? কয়েক বছরে একটা লেখা ছাপা হলেও সাময়িকী পাতাতেই লিখব। কোনদিন কোন লেখক আমাকে নারী বলে ন্যূনতম ছোট করে দেখেনি, বরং প্রচুর বিস্ময় দেখেছি, কীভাবে আমি এমন লিখতে পারি? আমি পুরুষদের এত গোপন, এত নিজস্ব বিষয় কীভাবে বুঝতে পারি? যথারীতি সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে পত্রিকার সম্পাদক আমাকে সাদরে আহবান করেছেন।
উইমেনআই ২৪ডটকম: আমাদের দেশে নারী সাহিত্যকের ভূমিকা এবং পরিস্থিতি নিয়ে কিছু জানতে চাই আপনার থেকে?
নাসরীন জাহান : নারী সাহিত্যিক বলে সাহিত্য জগতে কোন জায়গা হয় না। জায়গা থাকা উচিতও না। অনেক ছোট থেকে শুনে আসছি, আপনার লেখা যে কোন নারীর, তা একেবারেই বোঝা যায় না। তারমানে পুরুষদের মতো? সব পুরুষ ভালো লিখে ফাটিয়ে দিচ্ছে? নারী সাহিত্যিক কে ভুলতে হবে, সে নারী।আলাদা নারী সংঘ, কী দরকার? এদেশে প্রচুর সাহিত্যিক, জেন্ডারে নারী, এখন দাপিয়ে লিখছেন। যোগ্যতা থাকলে এসবে আটকায় আমি বিশ্বাস করি না। নিজেকে নিজে বড় মনে করে ঘ্যানঘ্যান করলেই তো হবে না।
উইমেনআই ২৪ডটকম: মাঝেমাঝেই বই প্রকাশে লম্বা বিরতি নিয়েছেন। কোন বিশেষ কারণ? আপনি কি মনে করেন বিরতি নিলে লেখার মান ভাল হয়?
নাসরীন জাহান : না, না এত লম্বা বিরতি হয়নি। মাঝে মাঝে এক বছর করে বাদ গেছে, ভালো লেখা আসছিল না তাই।এটা ডিপেন্ড করে, কার কতটা গ্যাপ দিয়ে লেখা দরকার।
উইমেনআই ২৪ডটকম: শিশুকালে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, সেসময় যে অভিজ্ঞতা তা পরবর্তীতে কি আপনার কোন লেখায় উঠে এসেছে?
নাসরীন জাহান : শৈশবের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার প্রায় পুরোটাই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস, সেই সাপ জ্যান্ত তে উঠে এসেছে।
উইমেনআই ২৪ডটকম: প্রত্যেক লেখকই নিজের লেখার মাঝে লুকিয়ে থাকেন বা একটি চরিত্র হয়ে দাঁড়ান। আপনার ভেতরের মানুষ কি কখনো আপনার লেখায় কোন চরিত্র হিসেবে উঠে এসেছে?
নাসরীন জাহান : লেখক অবশ্য অবশ্যই থাকেন চরিত্রের মধ্যে, আমি আমার রচিত উপন্যাস, গল্পের অনেক চরিত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি। নারী পুরুষ দু রকম চরিত্রতেই প্রায় সমানভাবে।
উইমেনআই ২৪ডটকম: একজন লেখকের কি কি গুন থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন ? ভাল লেখক হতে গেলে কি কি চর্চা করতে হবে?
নাসরীন জাহান : ভালো লেখক হতে হলে সবার আগে ভালো মানুষ হতে হবে। পক্ষপাতিত্ব করা চলবে না, অন্তত শিল্পের ক্ষেত্রে ন্যূনতম নয়। ব্যক্তি আক্রোশ, সাহিত্যক সত্তার কাছে আসতে দেয়া যাবে না।
প্রচুর বাছাই করে করে ভালো বই পড়তে হবে। বই-ই সাহিত্যিক এর সারাজীবনের গুরু।
লেখক পরিচিতি: নাসরিন জাহানের জন্ম ১৯৬৪ সালের ৫ মার্চ ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট গ্রামে। তাঁর বাবার নাম গোলাম আম্বিয়া ফকির, মা উম্মে সালমা। জীবনসঙ্গী আশরাফ আহমেদ এবং কন্যা অর্চি অতন্দ্রিলাকে নিয়ে তাঁর একান্ত সংসার।
আশির দশকের প্রারম্ভ থেকে তার অনুপ্রবেশ ছোটগল্পে। পাঁচটি সফল গল্পগ্রন্থের পর তিনি লিখতে শুরু করেন উপন্যাস।সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে তিনি সেই দুর্লভ লেখকদের একজন, যিনি উপন্যাস এবং ছোটগল্প--দুটি ক্ষেত্রেই সমান দক্ষতায় উৎকর্ষিত।
সাহিত্যচর্চাকেই বেছে নিয়েছেন জীবিকা হিসেবে, তিনি পাক্ষিক পত্রিকা অন্যদিনের সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন।
তিনি ‘উড়ুক্কু’ উপন্যাসের জন্যে পেয়েছেন ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, ‘পাগলাটে এক গাছ বুড়ো’ কিশোর উপন্যাসের জন্য আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, সীতাকুণ্ড সাহিত্য পুরস্কার, খুলনা রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য লাভ করেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার।
কথাসাহিত্যের পাশাপাশি তিনি এখন নাট্যসাহিত্যের সাথে নিজেকে গভীরভাবে সম্পৃক্ত করেছেন।
উইমেনআই২৪ডটকম/জে/ ১৫-০৩-২০২২/১১.২৮ পি এম