উইমেনআই২৪ ডেস্ক: হালিমা আদেন হচ্ছেন প্রথম হিজাবী সুপারমডেল। তিনি হিজাবের ধরনে এমন শৈল্পিকতা এনেছেন যাতে করে মুসলিম নারী ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তি ঠিক রেখে তা পরিধানের রুচিবোধ করে। নন্দনীয় ও দর্শনীয় নানা ঢংয়ের হিজাব পরে তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। হালিমার উদ্দেশ্য মুসলিম নারীকে যাতে হিজাব পরার ক্ষেত্রে একটিকে বেছে নেবার মত কঠিন কাজটি না করতে হয়।
হালিমা বলেন, ‘আমি চাই মেয়েরা জানুক যে হালিমা তাদের সবার জন্য একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আমি আমার কেরিয়ার ত্যাগ করেছি - যাতে তারা যে কোন জায়গায় কথা বলতে জড়তা বোধ না করেন।’
এখন ফ্যাশন জগতের বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো পথ খুঁজছে - যাতে হালিমাকে যে চাপের মুখে পড়তে হয়েছিল তা যেন অন্য মুসলিম মডেলদের ক্ষেত্রে না হয়।
ডিজাইনার টমি হিলফিগার এ ব্যাপারে বলছেন, ‘আমার মনে হয় ফ্যাশন শিল্পের জন্য এটা একটা বার্তা যে তাদের জেগে উঠতে হবে। কারণ আমার মনে হয় অন্য ব্র্যাণ্ড এবং ডিজাইনাররা বলছিল, আমরা কী কোন ভুল করলাম?’
টমি হিলফিগার এর আগে হালিমাকে নিয়ে বহু ফ্যাশন প্রচারাভিযানে একসঙ্গে কাজ করেছেন। সম্প্রতি বিবিসি তাদের একটি সাক্ষাৎকার নেয়। তাতে তারা এই শিল্পে বর্ণবাদ ও বৈষম্য মোকাবিলার নানা দিক নিয়ে কথা বলেন।
আদেন বলেন, ‘আমি এমন এক জায়গায় পৌঁছেছিলাম যেখানে আমি নিজেকে যেভাবে দেখি তার থেকে অনেক দুরে সরে যাচ্ছিলাম। আমার হিজাব ক্রমশ ছোট হয়ে আসছিল।’
তিনি বলেন, ‘একবার আমি একটা শুটিং করছিলাম সেখানে আরেকটি মুসলিম মেয়ে ছিল যে হিজাব পরতো। ওরা আমাকে আমার পোশাক পরিবর্তনের জন্য আলাদা একটা কুঠরি দিল, কিন্তু ওই মেয়েটিকে বললো, একটা বাথরুমে গিয়ে পোশাক বদলাতে। তো যখন আমি দেখলাম যে আমাদের প্রতি সমান আচরণ করা হচ্ছে না - সেটা আমার একেবারেই ভালো লাগেনি।’
আরেকদিন তাকে পোশাক বদলাবার জন্য এমন একটা জায়গা দেয়া হলো যেখানে যেতে হলে পুরুষদের পোশাক পরিবর্তনের জায়গাটার ভেতর দিয়ে যেতে হয়।
হালিমা বলেন, ‘এতে আমি খুবই অস্বস্তিকর একটা পরিস্থিতিতে পড়ে গেলাম।’
হালিমাকে টমি হিলফিগার বলেন, ‘এটা শুনলে আমি খুব বিপন্ন বোধ করি যে কিছু লোক বা স্টাইলিস্ট আছে - তারা আপনি যা বা আপনি যেভোবে চলেন - তা পাল্টে দিতে চায়।’
টমি হিলফিগার অনেক দিন ধরেই ফ্যাশন শিল্পে আরো বেশি বহুত্ববাদ এবং অন্যদের জায়গা করে দেবার আহ্বান জানিয়ে আসছেন।
ফ্যাশন জগতে বহু সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে টমি হিলফিগার ২০২০ সালে দেড় কোটি ডলার দেবার অঙ্গীকার করেছিলেন। প্যারিস ফ্যাশন উইকের সময় তিনিই হালিমাকে প্রথম ক্যাটওয়াকে তোলেন।
স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড ম্যাগাজিনে হালিমা আদেনই প্রথম মডেল হিসেবে বুরকিনি পরেছিলেন। শুধু তার জন্য এই সুইমস্যুট বানিয়েছিলেন টমি হিলফিজার।
টমি বলেন, ‘আমার মনে আছে তোমার জন্য আমরা একটা বিশেষ সাঁতারের পোশাক বানিয়েছিলাম।’
হালিমা বলেন, ‘বুরকিনি পরাটা ছিল এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা। ফ্রান্সের মত কিছু দেশে পাবলিক সুইমিংপুলে এবং সমুদ্রসৈকতে এই বুরকিনি নিষিদ্ধ করা হয়। কাজেই স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেডের ওই সুইমস্যুট প্রকাশের মধ্যে দিয়ে আমরা নিশ্চিতভাবেই একটা বার্তা দিয়েছিলাম, একটা নাড়া দিতে পেরেছিলাম। তবে এই সীমাবদ্ধতা ভাঙা এবং বদ্ধমূল ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার এই যাত্রাপথ মোটেও সহজ সরল ছিল না।’
'লোকে অসন্তুষ্ট হয়েছে'
হালিমা বলেন, ‘আমার মনে হতো আমি যেন একটা খুব সরু দড়ির ওপর হাঁটছি, এবং কখনো কখনো মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকরাও আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছে।’
নিউ ইয়র্ক ফ্যাশন উইক ২০১৬ তে আনিসা হাসিবুয়ানের ডিজাইনের পোশাক কালেকশন।
‘আমি বহু মন্তব্য শুনেছি যেগুলো ছিল এই রকম - 'বুরকিনি পোশাকটায় শরীরের গঠন খুব বেশি ফুটে ওঠে'। তবে অনেক অল্পবয়েসী মেয়ে সবসময় আমাকে মেসেজ পাঠাতো "আমরা তোমাকে ব্যতিক্রমী চেহারায় দেখতে চাই। আমরা তোমার স্কার্ফ ভিন্নভাবে পরা দেখতে চাই।
বিবিসি এমন কয়েকজন মডেলের সঙ্গে কথা বলেছে যারা ভিন্ন ধরনের সামাজিক পটভূমি থেকে আসা, এবং তারা ফ্যাশন জগত সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতাটা টমি ও হালিমার সঙ্গে শেয়ার করতে চায়।
রামলা অসোবলে একজন মুসলিম মডেল - যার বয়স ২২। তিনি বলছেন, তিনি যাদের সঙ্গে কাজ করেছেন তাদের কেউ কেউ এটা বুঝতে চাইতো না যে কিছু পোশাক আছে যা রামলার ধর্মবিশ্বাসে অনুমোদিত নয়।
‘একজন স্টাইলিস্ট আমাকে প্রশ্ন করেছিল যে আমি একটা আঁটোসাঁটো পোশাক পরবো কীনা। তখন আমাদের মধ্যে এক বিরাট বিতর্ক হলো। কারণ আমি তাদের বললাম যে আমি এতটা শরীর-দেখানো পোশাক পরতে ইচ্ছুক নই।’,
রামলা বলেন, ‘আরেকবার আমাকে একজন ফটোগ্রাফার প্রশ্ন করেছিল যে আমি পার্কের মাঝখানে কাপড় বদলাতে রাজি কিনা। আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।’
হালিমা আদেন হচ্ছেন এমন একজন যার মাথায় স্টাইলিস্টরা জিন্স ও অন্য নানা রকম কাপড় পরিয়েছেন - তাই তার কাছে এ ব্যাপারটা নতুন ঠেকেনি।
পরিবর্তনের সময় এসেছে
রামলার গল্প শুনে টমি হিলফিগারও মর্মাহত হলেন। তিনিও চান, হালিমা এবং রামলার মত মেয়েরা যে বৈষম্যের শিকার হয়েছে তার মোকাবিলা করতে।
তিনি বলেন, ‘এ গল্প শুনে আমার সত্যি রাগ হচ্ছে, আমার মনে হয় এটা খুবই অসম্মানজনক। তিনি, ‘এমন একটা ব্যবসা বা সম্প্রদায়ের অংশ হওয়াটা খুবই লজ্জাজনক যাদের মধ্যে এরকম বস্তাপচা ধারণা কাজ করছে।’
‘আমার আশা যে আমি সেই পরিবর্তনের একজন নেতা হতে পারবো। তা ছাড়া আমি বিশ্বাস করে যে এ পরিবর্তনটা ওপর থেকেই শুরু হবে।’
পৃথিবীর বড় বড় ফ্যাশন ব্র্যাণ্ডগুলো এখন অঙ্গীকার করেছে যে তারা তাদের কোম্পানির সকল স্তরে বহুত্ববাদ নিশ্চিত করবে।
তবে ২০১৯ সালে ম্যাককিনসে এ্যান্ড কোম্পানির "কর্মক্ষেত্রে নারী" শীর্ষক এক জরিপের উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে যে ফ্যাশন জগতের কোম্পানিগুলোর বোর্ড অব ডাইরেক্টরদের প্রতি চার জনের তিনজনই শ্বেতাঙ্গ পুরুষ।
কেইলিন স্ট্যামার্স হচ্ছেন ২৩-বছর বয়স্ক একজন কৃষ্ণাঙ্গ মডেল। তিনি জানতে চান, সবক্ষেত্রে সবার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে টমি কী করছেন।
টমি আরো বলেন, ‘যে সব কাস্টিং ডাইরেক্টর বা স্টাইলিস্টরা আমাদের হয়ে কাজ করেছে তার যখন আমাকে বলেছে যে অমুক মেয়েটি কিছু কারণে এ কাজের উপযুক্ত নয় - তাদের সাথে আমি অনেক লড়াই করেছি।’
‘আমি তাদের বলেছি - দেখ, দরজার ওপর আমার নাম লেখা আছে। তুমি আমার জন্য কাজ করো, আর আমরা তাই করছি - যা আমি করতে চাই।’
এ বছর ফ্যাশন শো-গুলোতে অনেক বহুত্ববাদী বৈচিত্র্য দেখা গেছে। মডেলদের মধ্যে ৪৩ শতাংশই ছিল অ-শ্বেতাঙ্গ।
আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিনগুলোর প্রচ্ছদে ২০২০ সালে অর্ধেকের সামান কম মডেল ছিল অ-শ্বেতাঙ্গ। তার আগের বছরের তুলনায় এ বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ১২ শতাংশ।
তবে পর্দার পেছনে কিন্তু এ বৃদ্ধির প্রতিফলন দেখা যায়নি। যুক্তরাজ্যে প্রতি ১০টি ফ্যাশন ডিজাইনের চাকরির মধ্যে একটিরও কম চাকরি পাচ্ছে অ-শ্বেতাঙ্গরা ।
টমি বলছেন, তার ব্র্যান্ডে ক্যাটওয়াকের সামনে ও পেছনে সব ক্ষেত্রেই বিভিন্ন বর্ণের মানুষেরা আছেন, সবাইকে সুযোগ দেয়া হচ্ছে।
আমরা একে অপরের জন্য কিছু করতে চাই
হালিমা আদেন গর্বিত যে তিনি শালীন ফ্যাশনকে বৈশ্বিক দর্শকের সামনে নিয়ে এসেছেন, এবং এমন একজন রোল-মডেল হয়ে ওঠতে পেরেছেন যাকে হিজাব-পরা মেয়েরা আদর্শ হিসেবে মানতে পারে।
‘আমি যখন মডেলিং-এ গেলাম, তখন ব্যাপারটা এমন ছিল যে আমি আমার কমিউনিটির অনেক মেয়ের জন্য দরজা খুলে দিয়েছি। আমি আগে কখনো একটা ম্যাগাজিন খুলে হিজার পরা কাউকে দেখিনি যার সাথে আমি আত্মীয়তাবোধ করতে পারি।’
তবে হালিমা দ্রুত খ্যাতির শিখরে উঠলেও, ধীরে ধীরে তার মনে হয়েছে যে এ শিল্প তার মুসলিম ধর্মের সাথে খাপ খাচ্ছে না।
তিনি এখন চান, অন্য আরো ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটাতে।
‘আমি এখন অন্য শিল্পের দিকে, অন্য ক্ষেত্রের দিকে তাকাচ্ছি - যেগুলোতে মুসলিম নারীদের জোরালো অবস্থান নেই। আমি চেষ্টা করছি কীভাবে সেখানেও এ ব্যাপারটা ভাঙা যায়, আমি কীভাবে প্রথমবারের মত কিছু করতে পারি। আমি এখন শরণার্থী সংকটের ওপর শিশুদের জন্য একটি বই লিখছি।’
হালিমা ফ্যাশন শিল্পে জাতিগত বৈচিত্র্য নিয়ে আরো সংলাপ চান, যেখানে মডেলরা অংশ নেবেন। এজন্য সবাই একসঙ্গে কাজ করবেন।
‘সবার ওপরে আমি চাই এখানে যেন সবাই সুযোগ পায়, একে অপরের জন্য ঐকান্তিকভাবে কাজ করে। আমার মনে হয় ফ্যাশনের ভবিষ্যৎ খুবই আশাব্যঞ্জক।’ বিবিসি বাংলা