ফারজানা ফাতেহা: ড. সালমা সুলতানা একজন বিজ্ঞানী, প্রাণী চিকিৎসক ও উদ্যোক্তা। ২০২১ সালে সিংগাপুরভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকীতে ১০০ এশিয়ান বিজ্ঞানীদের তালিকায় তিনি ৮ম স্থান দখল করেন। ড. সালমা সুলতানা বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি প্রাণী স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র মডেল লাইভস্টক এডভান্সমেন্ট ফাউন্ডেশন (এমএলএএফ) গড়ে তোলেন। গবেষণা ও কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ ২০২০ সালে তাকে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ ফাউন্ডেশন থেকে নরম্যান বােরলগ অ্যাওয়ার্ড ফর ফিল্ড রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশন পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এছাড়া ২০১৭ সালে জয় বাংলা ইউথ অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
নিজ পায়ে দাঁড়াবার সহজ ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সামাজিক কল্যাণ ও কর্মসংস্থানের পারিপার্শ্বিক দিক বিবেচনায় সব প্রতিকূলতা দূর করে শক্ত হাতে তিনি নিজেকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছেন। গুণী এই নারী সাক্ষাৎকারে উইমেনআই২৪ ডটকমকে তার জীবন সংগ্রামের গল্প শুনিয়েছেন:
উইমেনআই২৪ ডটকম: যদি জিজ্ঞেস করি কেমন ছিল ছােট বেলার সালমা সুলতানা..
ড. সালমা সুলতানা: ‘আমার শৈশব কাটে দিনাজপুর শহরের প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে। খুব বেশি চঞ্চল ছিলাম না কিন্তু খেলাধুলা করতে খুব পছন্দ করতাম। কোনোরকম স্কুল থেকে এসেই সহপাঠী ও প্রতিবেশী বন্ধুদের নিয়ে দৌঁড় দিতাম মাঠে। গােল্লাছুট ও বর্শা নিক্ষেপসহ প্রায় সকল ধরনের খেলাধুলা করতাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক ক্রিয়ায় অংশ নিতাম।’
উইমেনআই২৪ ডটকম: স্কুল জীবনে নিজেকে নিয়ে কী ভাবতেন, কোথায় দেখতে চাইতেন নিজেকে?
ড. সালমা সুলতানা: ‘স্কুল জীবনে আমি বড় হয়ে কবি সাহিত্যিক হতে চেয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎ চন্দ্রের লেখা খুব পছন্দ করতাম আর টুকটাক লেখালেখিও করতাম।’
উইমেনআই২৪ ডটকম: বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ক্যারিয়ার নিয়ে কি ভাবতেন?
ড. সালমা সুলতানা: ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি খুব হতাশ ছিলাম। কারণ আমাদের দেশে একজন মানব চিকিৎসক যে সম্মান ও গুরুত্ব পান সেই তুলনায় একজন পশু চিকিৎসকের গ্রহণযােগ্যতা খুবই কম এবং সম্মানের চোখে দেখা হয় না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আমাদেরও তাদের মতাে অনেক পড়াশােনা ও ত্যাগ স্বীকার করে পাশ করতে হয়। মানুষ আমাদের কাজ বুঝে না, হুট করেই বলে ফেলে ও আপনি গরুর ডাক্তার? তবে ৩য় বর্ষে পড়ার সময় আমি বিভিন্ন দেশে স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চতর পড়াশােনা করার খােঁজ নিতে থাকি তখন বিদেশে এই পেশার গুরুত্ব ও সম্মান দেখে আমার মধ্যে হতাশা কমে এবং আমি নতুনভাবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।’
উইমেনআই২৪ ডটকম: চাকুরির সুযােগ পাওয়ার পরও কেন উদ্যোক্তা হতে হলাে? প্রতিষ্ঠান তৈরির অনুপ্রেরণা ও পেছনের গল্পটি যদি বলেন..
ড. সালমা সুলতানা: ‘অনার্স শেষ করার পরই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রজেক্টের কাজে আমার চাকরি হয়ে গেলাে। যখন মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করলাম তখন দেখলাম গ্রামের মানুষের একমাত্র সম্বল তাদের পােষা প্রাণীটির প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে। তারপর অবস্থার বেশি অবনতি হলে আমাদের কাছে আনা হয়, তখন আর বেশি কিছু করার থাকে না। একদিন অনেক রাতে একটি গরুকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য জরুরি ডাক পড়লে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হয়নি।সঠিক চিকিৎসার অভাবে তাদের গরুটি মারা গেল। বিষয়টি আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিল। বুঝতে পারলাম এ সেক্টরে ডাক্তারের পাশাপাশি দক্ষ জনবল দরকার, যারা চিকিৎসকের নির্দেশ ও পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে পারবে। যেই কথা সেই কাজ, চাকরি ছেড়ে দিয়ে মাস্টার্স এর জন্য ভর্তি হয়ে গেলাম। এর মধ্যেই খােঁজ খবর নিতে থাকলাম কী করা যায়। ২০১৫ সালে থিসিস শেষ করে পেপার জমা দিয়ে ঢাকায় চলে আসি। এসেই কাগজপত্র তৈরি করে ঢাকার ডেমরায় তৈরি করি এমএ্লএএফ, এটা অনেক কঠিন কাজ ছিল যার জন্য আমাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। আমার অনুপ্রেরণা ওই একটাই; এই সেক্টরের অর্থনৈতিক ক্ষতি কমানাে, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও চিকিৎসার জন্য দক্ষ জনবল তৈরি করা।’
উইমেনআই২৪ ডটকম: মেয়ে হয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার চ্যালেঞ্জ কেমন ছিল? চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাধাগুলো কিভাবে দূর করেছেন?
ড. সালমা সুলতানা: ‘মেয়ে হয়ে উদ্যোক্তা হবাে এটা যেন কেউ মেনেই নিতে পারছিল না। প্রথম বাধাটা পাই পরিবার থেকে, সেটা ছিল মনস্তাত্ত্বিক বাধা। বাবা-মায়ের প্রথম কথা ছিল সরকারি চাকরি করবাে। তাদেরকে আমার স্বপ্নের কথা বােঝাতে অনেক বেগ পােহাতে হয়। প্রতিষ্ঠানের অনুমােদনের কাজেও সরকারি অফিসাররা অনেকে ভেবেছে মেয়ে মানুষ পারবে কী- না! পরবর্তী বাধা হয় টাকা যােগান নিয়ে। যেখানে এদেশে একটা ছেলেকেই সহজে মূলধন দেয় না, সেখানে একটা মেয়েকে দেয়ার সাহসই করে না কেউ। শেষ অবধি আমার বাবা আমাকে মূলধন দেয় এবং আমি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাই। শুরুতে অনেক সংস্থা আমাদের কাজ দিতাে না, সন্দেহ করতো পারবাে কী-না। এখন আলহামদুলিল্লাহ অনেক বড় বড় বিদেশি সংস্থার সঙ্গে কাজ করি।’
উইমেনআই২৪ ডটকম: আপনার কাছে সফলতা মানে কি? আপনার সফলতার পেছনে কি রহস্য কাজ করেছে বলে মনে করেন?
ড. সালমা সুলতানা: ‘আমার কাছে সফলতা হলাে নিজে খুশি থাকা আর অন্যের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কিছু করতে পারা। কোনো রূপকথার গল্পের মতাে সফলতা আসেনি। অনেক ত্যাগ, ভাগ্য, ধৈর্য, পরিশ্রম আর অবিরত কাজের ফলাফল আজকের এই সফলতা।’
উইমেনআই২৪ ডটকম: এ পেশার ভবিষ্যত কি? নতুনরা এ পেশায় আসতে চাইলে কি পরামর্শ দিবেন...
ড. সালমা সুলতানা: ‘দেখুন এ পেশার ভবিষ্যত অবশ্যই উজ্জ্বল। তবে সেই পথটি আমাদের তৈরি করে নিতে হবে। প্রাণী সম্পদে আমাদের দেশ এখন স্বনির্ভর তাই সময় এসেছে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিতকরণ। তাই এই সেক্টরে অনেক পশু চিকিৎসক দরকার হবে। তারা শুধু চিকিৎসাই দিবে না, তারা প্রাণী সম্পদের নিরাপদ উৎপাদন নিশ্চিতকরণে কাজ করবে। প্রতি বছর একটা বিশাল সংখ্যক পশু চিকিৎসক পাশ করেন কিন্তু মাঠ পর্যায়ে তাদের আর পাওয়া যায় না।’
উইমেনআই২৪ ডটকম: আপনারা কেনাে প্রাইভেট চেম্বার এ চিকিৎসা দিচ্ছেন না...
ড. সালমা সুলতানা: ‘একদল মানুষ বিভ্রান্ত ছড়াচ্ছে্এমএলএএফ এর মতাে প্রতিষ্ঠান তাদের কাজের ক্ষেত্র কমিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমরা পশু চিকিৎসকদের জন্য দক্ষ নার্স ও টেকনিশিয়ান তৈরি করছি। তারাতাে ডাক্তার নয় বরং সাহায্যকারী। আমি বলবাে এতে আপনাদের কাজের আরাে সুযােগ বাড়ছে। ’
উইমেনআই২৪ ডটকম: ২০-২৫ বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে, ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা ও হতাশা কাজ করে। এ সময়ে আপনার সংগ্রাম কি ছিল এবং তা কিভাবে অতিক্রম করেছেন? সবার বাবা-মায়েরাই চায় তাদের অনুপস্থিতে তাদের মেয়ে যেন নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাস করতে পারে...
ড. সালমা সুলতানা: ‘আমার বাব-মাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। অনার্স প্রথম বর্ষ থেকেই আমার জন্য ছেলে দেখা শুরু করেছিলেন। আমি কোনোভাবেই চাচ্ছিলাম না এতাে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলি। আমি আগে পড়াশােনা শেষ করতে চাই বলে তাদেরকে বুঝালাম। আমার বাবা মা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন এবং আমাকে ক্যারিয়ার গড়ার সুযােগ করে দিলেন।’
উইমেনআই২৪ ডটকম: এশিয়ার শত বিজ্ঞানীদের মাঝে কিভাবে সেরা দশে স্থান পেলেন?
ড. সালমা সুলতানা: ‘২০২০ সালে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ ফাউন্ডেশন থেকে আমি সম্মাননা পাই। এটি একটি আন্তর্জাতিক সম্মাননা। এর আগে ড. মুহাম্মদ ইউনুস ও ফজলে আবিদ স্যার এই সম্মাননা পান। তৃতীয় বাংলাদেশি হিসেবে আমি মনােনিত হই। এ বছরের অক্টোবরে আমি আমেরিকায় যাবাে সেই পুরস্কার আনতে, ইনশাআল্লাহ। ‘দ্য এশিয়ান সায়েন্টিস্ট ১০০’ আমার সেই পুরস্কারের সূত্র ও আমার গবেষণা পত্র দেখে আমাকে মনােনিত করে। বিষয়টি আমি আগে জানতামও না।’’
উইমেনআই২৪ ডটকম: ভিনদেশে নিজেকে একজন বাংলাদেশি হিসেবে উপস্থাপন করার অনুভূতি কেমন ছিল?
ড. সালমা সুলতানা: ‘এটা সত্যিকার অর্থে অসাধারণ এবং বলে বুঝানাে সম্ভব নয়। যখন আমি অন্য দেশের মানুষের সামনে আমার পরিচয় দেই তখন নিজের নামের পরেই বলি আমি একজন বাংলাদেশি। সেই মুহূর্তে নিজেকে ও নিজের কাজকে সার্থক মনে হয়।’
উইমেনআই২৪ ডটকম: ভবিষ্যতে নিজের কাজকে কোথায় দেখতে চান?
ড. সালমা সুলতানা: ‘আমি বাংলাদেশের প্রতিটা খামারকে মডেল খামার হিসেবে দেখতে চাই। উৎপাদিত গরু, ছাগল, হাস, মুরগী, ডিম, দুধ ও মাছসহ সকল প্রাণী খাদ্য বিষমুক্তভাবে জনগণের হাতে যেনাে দিতে পারি সেই লক্ষ্যে আমি ও আমার প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাবাে। দেশে প্রাণী সম্পদের অর্থনৈতিক ক্ষতি যাতে কমে সেই লক্ষ্যে খামারি ও জনগণকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যেতে চাই।’