প্রফেসর ডাঃ মোঃ সাঈদুল আলম প্রিন্স,পরিচালক ও প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা,ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার মেডিসন, বাংলাদেশ পরমানু শক্তি কমিশন, ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের প্রায় ৫ কোটি মানুষের বিভিন্ন থাইরয়েড সমস্যা রয়েছে বলে জানিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব ক্লিনিক্যাল এন্ড্রোক্রাইনোলজি অ্যান্ড ডায়াবেটোলজিস্ট অব বাংলাদেশ (এসিইডিবি)। তবে এসব রোগীর অর্ধেকের বেশি মানুষ জানে না যে তারা এ সমস্যায় ভুগছেন। এছাড়া পুরুষদের তুলনায় নারীরা চার থেকে পাঁচগুণ বেশি আক্রান্ত হন বলে জানিয়েছেন থাইরয়েড বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিনিয়তি থাইরয়েডে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে তবে সে অনুযায়ী চিকিৎসক বাড়ছে না। বাংলাদেশে সরকারি পুরনো ৮ টি মেডিকেল কলেজের এ চিকিৎসা দেওয়া হয়। নতুন করে আরও ৬টি মেডিকেল কলেজে এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ খোলার মাধ্যমে হরমোনজনিত রোগের চিকিৎসার জন্য জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে সরকারি পর্যায়ে প্রায় ১০০ হরমোন বিশেষজ্ঞ কাজ করে যাচ্ছেন। আর বেসরকারি পর্যায়ে ২০০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কাজ করছেন।
থাইরয়েড রোগ কি?
থাইরয়েড হলো ছোট একটা গ্রন্থি, যা ঘাড়ের সামনের দিকে শ্বাসনালীর চারপাশে আবৃত থাকে। এর আকৃতি অনেকটা প্রজাপতির মতো, মাঝখানে ছোট দুটি ডানা আছে।
আমাদের শরীরে অনেকগুলো গ্রন্থি আছে, এগুলো আমাদের শরীরে একটা নির্দিষ্ট কাজ করতে সহায়তা করে৷ থাইরয়েড তেমনি একটা গ্রন্থি।
এই গ্রন্থির কাজ মূলত আমাদের শরীরের কিছু অত্যাবশকীয় হরমোন (থাইরয়েড হরমোন) উৎপাদন করা। শরীরে এই থাইরয়েড হরমোনের আবার একটা নির্দিষ্ট মাত্রা আছে। নির্দিষ্ট মাত্রার চাইতে কম বা বেশি হরমোন উৎপাদিত হলেই শরীরে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
শরীরে থাইরয়েড হরমোন কম উৎপন্ন হলে বলা হয় হাইপোথাইরয়েডিজম এবং বেশি উৎপন্ন হলে বলা হয় হাইপারথাইরয়েডিজম। থাইরয়েড সমস্যা হলে শরীরে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।
এই বিষয় নিয়ে আমাদের বিস্তারিত জানিয়েছেন থাইরয়েড বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডাঃ মোঃ সাঈদুল আলম প্রিন্স
থাইরয়েড রোগের লক্ষণ:
#.ক্লান্তি ক্লান্তি ভাব
#.অল্পতেই শীত শীত লাগবে
#.কোষ্ঠকাঠিন্য
#.ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া
#.হঠাৎ করে অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি পাওয়া বা কমে যাওয়া
#.অনেক সময় মুখ ফুলে যেতে পারে
#.গলার স্বর বদলে যেতে পারে
#.পেশীর দুর্বলতা
#.পেশীতে ব্যথা
#.নারীদের ক্ষেত্রে মিন্সট্রুয়াল সাইকেল পরিবর্তন হয়ে যাওয়া
#.ডিপ্রেশন
#.চুল পড়ে যাওয়া বা চুল পাতলা হয়ে যাওয়া
#.স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া
থাইরয়েড রোগে কাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি?
থাইরয়েডে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন৷ অনেকে ধারণা করেন, শুধু নারীদের এই রোগ হয়ে থাকে। তবে এই ধারণাটি ভুল। পুরুষেরও এই রোগটি হতে পারে৷ তবে পুরুষদের তুলনায় নারীদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে৷
বিশেষ করে মেনোপজ হওয়ার পর থেকে নারীরা এই রোগে আক্রান্ত হন বেশি৷ তাই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীদের এই রোগ নিয়ে সচেতন হতে হবে।
থাইরয়েড সমস্যার কারণ:
থাইরয়েড রোগের ২টি প্রধান ধরন হল হাইপোথাইরয়েডিজম এবং হাইপারথাইরয়েডিজম। উভয় অবস্থাই অন্যান্য রোগের কারণে ঘটতে পারে, যা থাইরয়েড গ্রন্থির কাজকে প্রভাবিত করে। নানা কারণে এই সমস্যা হতে পারে।
যেমন –
#.আয়োডিনের অভাব
#.শরীরে অন্যান্য গ্রন্থির ঠিক করে কাজ না করা
#.থাইরয়েড গ্রন্থির জন্মগত ত্রুটি
#.থাইরয়েড সমস্যার চিকিৎসা
থাইরয়েড হলে করণীয়:
যেকোনো রোগের কবল থেকে বাঁচতে চিকিৎসার বিকল্প নেই। চিকিৎসা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে, সেইসঙ্গে মেনে চলতে হবে কিছু নিয়ম-নীতি। কিন্তু থাইরয়েড রোগের চিকিৎসা নির্ভর করে থাকে রোগীর শরীরের অবস্থা এবং রোগের ধরনের ওপর। অন্য কোনো রোগের কবল থেকে মুক্তি পেতে কিছু প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সুস্থতা আশা করা যায়। কিন্তু থাইরয়েড রোগের চিকিৎসার প্রধান বিষয় হলো চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার, হরমোন ও বিকিরণ।
থাইরয়েড রোগের আরো বিস্তারিত বিষয় নিয়ে ওমেনআইয়ের সাথে কথা বলেছেন থাইরয়েড বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডাঃ মোঃ সাঈদুল আলম প্রিন্স।পরিচালক ও প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ,ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার মেডিসন,
বাংলাদেশ পরমানু শক্তি কমিশন।
ওমেনআই২৪ডটকম: থাইরয়েড রোগের প্রাথমিক লক্ষণ কি? কাদের বেশি থাইরয়েড হওয়ার ঝুঁকি থাকে?
ডাঃ প্রিন্স: প্রথমত থাইরয়েড রোগ মেয়েদের বেশি হয়। যদি ৮ জন মেয়ের থাইরয়েড রোগ হয় তাহলে ছেলেদের হবে একজন। রেশিওটা হচ্ছে ৮: ১। মেয়েরা যেহেতু প্রেগন্যান্ট হয় মেয়েদের যেহেতু হরমোনাল ইনফ্লুয়েন্স টা বেশি বডিতে। যার কারনে মেয়েরা বেশি ওবিসিটি হয়। তাদের চর্বির মাত্রাটা বেশি থাকে। এসব কারণে মেয়েদের হরমোনের রোগ এমনিতেই বেশি হয়। শুধু থাইরয়েড বলে কথা নয়। সব ধরনের হরমোনের রোগী মেয়েদের বেশি হয় এবং থাইরয়েডের বেলায় সেটা খুবই সত্যি ।
দ্বিতীয়তঃ থাইরয়েড এর সাথে একটা ব্যাপার আছে বিশেষ করে খাওয়া দাওয়া বা আয়োডিনের বেশি ঘাটতি হলে কিংবা আয়োডিন বেশি হলে মনে রাখবেন আয়োডিনের শুধু ঘাটতি নয় আয়োডিন বেশি হলেও দুটাই খারাপ। আয়োডিনের ঘাটতি হলেও থাইরয়েড রোগ হবে। বেশি হলেও থাইরয়েড রোগ হবে। সেজন্য আয়োডিন পরিমাণ মতো খেতে হবে। আমাদের দেশে সমস্যা হলো, আমাদের গলা ফোলা আমরা গলার ডাক্তারের কাছে চলে যাই এটা আসলে গলার রোগ না এটার জন্য থাইরয়েড বিশেষজ্ঞ এর কাছে যেতে হবে। কারণ থাইরয়েড রোগ হচ্ছে অনেক রকমের। থাইরয়েড রোগের ধরন বললে লম্বা লিস্ট হবে। একেকটা বয়সে একেক রকম ধরন। যেমন নারীদের প্রেগনেন্সিতে একরকম রোগ হয় পুরুষদের এক ধরনের রোগ হয়।
ওমেনআই২৪ডটকম: একজন নারীর থাইরয়েড রোগ হলে কনসিভ করতে সমস্যা হয় হলে আমরা জানি,। সে ক্ষেত্রে করণীয় কি?
প্রফেসর ডাঃ মোঃ সাঈদুল আলম প্রিন্স, ছবি: সংগৃহীত
ডাঃ প্রিন্স: খুবই ভালো প্রশ্ন আসলে সত্যি কথা থাইরয়েড আক্রান্ত নারীর বেলায় যেটা হয়, যেসব নারীর থাইরয়েড রোগ আছে। বিশেষ করে হাইপার থাইরয়েডিজম এসব রোগীদের দেখা যায় যে তাদের বাচ্চা সমস্যা হয় এক্ষেত্রে সেসব নারীদের আর্লি ডায়গনোসিস করা। যদি চিকিৎসাটা তাড়াতাড়ি শুরু করা যায় তাহলে লং টার্ম এফেক্ট হয় না। তাদের জন্য বাচ্চা হওয়াটা বা বাচ্চার ইনফার্টিল দূর করা খুব সহজ। যদি তার লম্বা সময় ধরে হাইপো থাইরয়েড বা হাইপার থাইরয়েডিজম থাকে তখন কিন্তু ইনফার্টিলিটি ম্যানেজ করা আসলেই খুব ডিফিকাল্ট হয়। আমার কথা হব, একজন রোগি যদি বুঝতে পারেন যে তার থাইরয়েড রোগ হয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাকে দ্রুত থাইরয়েড বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে। থাইরয়েডের চিকিৎসা শুরু করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে থাইরয়েড চিকিৎসা কিন্তু মাল্টি ডাইমেনশনাল চিকিৎসা। কেননা এক্ষেত্রে শুধু ওষুধ নয়। ওষুধের সাথে লাইফ স্টাইল খাওয়া- দাওয়া অর্থাৎ একজন রোগী কে পুরো প্যাকেজটা কি ফলো করতে হবে। শুধু ওষুধ খেলেই হবে না। রোগীকে নিয়মিত ফলোআপে থাকতে হবে এবং চিকিৎসা নিয়ে হারিয়ে গেলে তা হবে না। রোগীকে নিয়মিত ফলোআপ করতে হবে। এবং এটা মনে রাখতে হবে যে রোগী কিন্তু যে কোন মুহূর্তে যেকোনো কন্ডিশনে এই রোগটা কিন্তু খারাপ হয়ে যেতে পারে। যখনই কোন স্ট্রেসে পড়বে তখন তার উচিত ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া। একই সাথে থাইরয়েডের ওষুধ যেহেতু লাইফ লং খেতে হয়, তাই সবসময়ই ডাক্তারের মনিটরিং এ থাকতে হবে।
ওমেনআই২৪ডটকম: গর্ভবতী মায়ের যদি থাইরয়েড রোগ থাকে বিশেষ করে বিশেষ করে উক্ত নারীর রোগীর যদি এসেসমেন্ট না থাকে তাহলে বাচ্চার উপর কি সেটার কোন প্রভাব পড়ে সে ক্ষেত্রে করনীয় কি?
ডাঃ প্রিন্স: এটা একটা খুবই জরুরী প্রশ্ন। অবশ্যই প্রভাব পড়ে। আপনারা জানেন যে, গর্ভবতী মা যদি থাইরয়েড রোগী হয়। হাইপার হোক বা হাইপো হোক যেটাই হোক। এটা মায়ের কাছ থেকে ওই বাচ্চাটাও আল্টিমেটলি পাবে। ফলে যদি হাইপোথাইরয়েড বাচ্চা হয় দেখা যায় যে তার জন্মগত হাইপার থাইরয়েড রোগ খুবই মারাত্মক হয়। যদি এক বছরের মধ্যে ডায়গনোসিস না হয় তাহলে কিন্তু ওই বাচ্চার পার্মানেন্ট হাইপো থাইরয়েড হয়ে যাবে এবং সেই বাচ্চার ব্রেন ডেভেলপ হবে না।মনে রাখতে হবে, থাইরয়েডে হরমোনটা বাচ্চার ব্রেন ডেভেলপ করে। যদি কোন কারণে তার হরমোন ডিফিসিয়েন্সি থাকে তাহলে কিন্তু ওই বাচ্চার ব্রেন ডেভেলপ হবে না। আর তাই এইজন্য আমরা যদি মায়ের ট্রিটমেন্ট করি গর্ভাবস্থায় তাহলে বাচ্চা সুস্থ হবে। গর্ভবতী মাকে দেড় দুই মাস পরপর থাইরয়েড বিশেষজ্ঞের মনিটরিং এ থাকতে হবে। আরেকটা বিষয় আছে, যেহেতু বাচ্চাটা হওয়ার পর দুধ খাওয়াতে হবে। যারা ব্রেস্ট ফিডিং করবেন তারা যদি হাইপো থাইরয়েড ওষুধ খায় সে সময় সেটা বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ ওষুধ খাওয়া অবস্থায় বাচ্চা কে ব্রেস্ট ফিডিং করতে পারবেন না। এটা একটা বড় সমস্যা। হাইপো থাইরয়েডের জন্য সে সমস্যা নেই। কিন্তু হাইপার থাইরয়েডিজমের বেলায় সেটা করা যায় না। যদি মাকে ওষুধ খেতেই হয় তাহলে বাচ্চাকে মায়ের দুধ খাওয়া বাদ দিতে হবে।
ওমেনআই২৪ডটকম: থাইরয়েড আক্রান্ত হওয়ার কোন নির্দিষ্ট বয়সসীমা আছে কি?
ডাঃ প্রিন্স : না। নবজাতক থেকে শুরু করি বৃদ্ধ বয়সে থাইরয়েড হতে পারে
//এল//