
সংগৃহীত ছবি
গ্যাভি, দ্য ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্সের ইউরো এশিয়া-প্যাসিফিকের প্রধান স্যাম মুলার বলেন, “প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত কমিউনিটির ৫৬ লাখ কিশোরীকে এইচপিভি টিকা প্রদানের মাধ্যমে আমরা শুধু তাদের জীবন রক্ষা করছি না, বরং একটি পুরো প্রজন্মের বিকাশের জন্য তাদের ক্ষমতায়নের দ্বার উন্মুক্ত করেছি। আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন নিবেদিতপ্রাণ সকল স্বাস্থ্যকর্মী এবং এই কার্যক্রমের সাথে যুক্ত সকল কমিউনিটির প্রতি যারা এটিকে সফল করেছেন।”
এই টিকাদান কর্মসূচি সফল করতে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয় তার মধ্যে ছিল মিডিয়াকে মোবিলাইজ করা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারাভিযান চালানো, কার্যক্রমের ব্যাপ্তি বাড়াতে সামাজিক ও আচরণগত পরিবর্তনে নিবিড়ভাবে কাজ করা, টিকা গ্রহণে সব ধরনের দ্বিধা মোকাবিলা করা এবং কোনো মেয়ে যাতে পিছিয়ে না থাকে তা নিশ্চিত করতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতন বৃদ্ধি করা। আনুষ্ঠানিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততাও এই অভিযানের সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে টিকাদান কার্যক্রমে কওমি মাদ্রাসা, সরকারি স্কুল ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলসহ আনুষ্ঠানিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্য জোরালো প্রচেষ্টা চালানো হবে।
গ্যাভি, ইউনিসেফ ও ডব্লিউএইচও দেশব্যাপী এইচপিভি টিকা প্রদান কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে অভিনন্দন জানায়; এই প্রজন্মকে জরায়ুমুখ ক্যান্সার থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে এটি একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক।
মঙ্গলবার ( ১১ ডিসেম্বর) স্যাম মুলার এ কথা বলেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, সিলেট ও রংপুর বিভাগে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের (এইচপিভি) টিকা প্রদান কার্যক্রমের চূড়ান্ত পর্যায় সম্পন্ন করেছে। এই কার্যক্রমে সহায়তা করেছে ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স গ্যাভি, ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
এই কর্মসূচির মাধ্যমে ৫৬ লাখ কিশোরীকে (লক্ষ্যমাত্রার ৯৩ শতাংশ যাদের বয়স ১০-১৪ বছর ) এইচপিভি টিকা প্রদান করা হয়েছে। যাদের মধ্যে রয়েছে সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কিশোরীরাও। নারীর জরায়ুমুখ ক্যান্সার রোধে এটি অপরিহার্য এক পদক্ষেপ।
জরায়ুমুখ ক্যান্সার হয় একটি সাধারণ ভাইরাস (এইচপিভি) থেকে এবং এটি গোটা বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশেও নারীর মৃত্যুর একটি অন্যতম কারণ। বাংলাদেশ প্রতি বছর জরায়ুমুখ ক্যান্সারে পাঁচ হাজারের বেশি নারী প্রাণ হারান।
তবে প্রাণঘাতী এই ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য। এর প্রথম ধাপ হলো, সব নারীকে কৈশোর বয়সেই এইচপিভি টিকা নিতে হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা এই টিকা নিয়েছেন তাদের মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রায় ৯০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে; এই টিকার ফলে তারা আসন্ন দুর্ভোগ, পারিবারিক বিপর্যয় এবং ব্যয় বহুল চিকিৎসার খরচ থেকে রক্ষা পেয়েছেন। বাংলাদেশে ২০০৮ সাল থেকে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা এইচপিভি টিকার গুরুত্বের কথা বলে আসছেন এবং গত কয়েক মাসে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো, যাদের এই টিকা দেওয়া হয়নি তাদেরসহ সব নারীর নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা নিশ্চিত করা যেন ভাইরাসটি ক্যান্সার কোষ তৈরির প্রাথমিক পর্যায়েই শনাক্তকরণের মাধ্যমে তাৎক্ষনিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ারস বলেন, "৯৩ শতাংশ মেয়েকে এইচপিভি টিকা দেওয়ার এই মাইলফলক অর্জিত হয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের ইপিআই প্রোগ্রামের নেতৃত্বে, এ জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই।''
তিনি আরও বলেন, ''এই কার্যক্রমে সাফল্যের বিষয়টি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার শক্তির কথা বলে, ডাক্তারদের প্রত্যয় ও প্রচেষ্টার কথা বলে- বিশেষ করে যারা এই টিকা প্রদান কর্মসুচিকে সমর্থন করে আসছেন। পাশাপাশি এটি তাদের কথা বলে- যারা এই প্রজন্মের অল্পবয়সী মেয়েদের জরায়ুমুখ ক্যান্সার থেকে সবচেয়ে ভালোভাবে সুরক্ষিত রাখতে বিভিন্ন কমিউনিটি, ধর্মীয় নেতা ও বাবা-মায়েদের সঙ্গে কাজ করছেন, এই কার্যক্রমকে গতিশীল করেছেন। যেহেতু এই টিকা আগামী বছর থেকে রুটিন টিকাদান কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, তাই প্রতিরোধযোগ্য এই জরায়ুমুখ ক্যান্সার নির্মূলের লক্ষ্যে এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ।”
এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচি সফল করতে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশাপাশি গ্যাভি টিকা ক্রয়, সরবরাহ ও টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত লজিস্টিক নিশ্চিত করতে অর্থায়নে সহায়তা করেছে। আর ইউনিসেফ এইচপিভি টিকাদান কার্যক্রমের সামগ্রিক পরিকল্পনা, পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে প্রান্তিক পর্যায়ে টিকা পৌঁছে দিতে ডব্লিউএইচও ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পাশাপাশি জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে অংশীজনদের সঙ্গে কাজ করেছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকে প্রতিদিনের ধারাবাহিক অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের বিষয়টি স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরকে পিছিয়ে থাকা এলাকাগুলো শনাক্ত করে সেখানে অতিরিক্ত সহায়তা ও মনোযোগ প্রদানে সক্ষম করে তোলে।
বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি (এ.আই) ডাঃ আহমেদ জামশীদ মোহামেদ বলেন, "এইচপিভি টিকাদান কার্যক্রমের এই সাফল্য, জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে কর্মরত মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন কমিনিটির নেতা এবং স্বেচ্ছাসেবকদের একত্রিত হয়ে কাজ করার শক্তি প্রমাণ করে। গুজব ও টিকা গ্রহণে দ্বিধার মতো প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিশ্বাস পুনর্গঠনে সময়োপযোগী পদক্ষেপ, ৯৩ শতাংশ কভারেজের সাফল্য অর্জনে আমাদের সক্ষম করেছে। ডব্লিউএইচও আইভিডি নেটওয়ার্কসহ আমাদের উন্নয়ন সহযোগীরা প্রযুক্তিগত ও কারিগরি সহায়তা প্রদান, কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে সহয়তা করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই মাইলফলক কেবল একটি ইপিআই বা টিকাদান কর্মসূচি নয়, এটি জরায়ুমুখ ক্যান্সারের মতো প্রতিরোধযোগ্য রোগ থেকে ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ প্রতিশ্রুতি।''
এই কর্মসূচি সফল হবার পেছনে আরও কয়েকটি বিষয় অবদান রেখেছে। যার মধ্যে রয়েছে মন্ত্রণালয়, লাইন বিভাগ (ডিপার্টমেন্ট), কমিউনিটি এবং ধর্মীয় নেতা, স্বেচ্ছাসেবক ও যুব সংগঠনগুলোর প্রান্তিক পর্যায়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং বিনামূল্যে টিকার অনবরত সরবরাহ।
//এল//