সংগৃহীত ছবি
আজ আমার একটি প্রিয় দিন।টরন্টো তে ঘরোয়া পরিবেশে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব জামিল চৌধুরীর জন্মদিন অনুষ্ঠিত হলো।তার সাথে আমরা কয়েকজন একান্ত ভাবে স্মৃতিচারণ শুনলাম।
দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার গনমাধ্যমের পথিকৃত জামিল চৌধুরী ৯০ বছরে পা দিলেন। টরনটোয় তার কন্যা এক ছোটোখাটো আনন্দঘন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের ডিআইটি বিল্ডিং এ পিটিভি পাইলট প্রজেক্ট স্টেশন এবং পরে রামপুরার টিভি ভবনের পুরো পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন হয় তারই প্রয়াসে । এ নিয়ে আজ অনেক কথা বললেন তিনি । এখনো কত সপ্রতিভ, সবই মনে আছে তাঁর।
একটি কাগজ যখন তার হাতে দিলাম, তিনি তাতে লিখলেন “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু “ বললেন “আমি এটাই বিশ্বাস করি ।
গনমাধ্যমের স্বাধীনতা তার কাছে কেমন জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দেন “ গনমাধ্যম পুরোপুরিই স্বাধীন, কর্তৃপক্ষের বাধা এখানে নেই, তবে ঝামেলাটা তৈরী হয় ভেতর থেকে”। যেমন কিনি বলেন “ আমি যখন পিটিভি পাইলট টিভি স্টেশন বা পরবর্তীতে বিটিভিতে যতই বাংলা প্রচলন বা বাংলায় চেক লেখার উদ্দোগ নিয়েছি, আমার আশে পাশের মানুষ বলেছে “ Don’t do it “ অর্থাৎ পরিবর্তন, আমরা নিজেরাই চাইনা ।
আর গনমাধ্যমের দায়িত্ব হচ্ছে সোজাসুজি মানুষের কথা বলা, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অন্যভাবে বলা নয়।
ষাটের দশকে তদানিন্তন পাকিস্তানের প্রেসিডেনট আইয়ুব খান তার রাজনৈতিক প্রচারনার জন্য একটি টেলিভিশন চালু করতে চান, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এনইসি সত্যিকার অর্থে এরকম একটি প্রকল্প চালুর ফিজিবিলিটি আসলেই সম্ভব কিনা তা দেখতে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের একজন পদার্থ বিজ্ঞানী জামিল চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে, যিনি বাংলাভাষা এবং সবাধীকার আন্দোলনের এক সপ্নদ্রষ্টা ছিলেন। এনইসি’র প্রস্তাবে জামিল চৌধুরী এককভাবে আলাপ আলোচনা শুরু করেন, প্রাথমিক ভাবে তার সিদেশ্বরীর বাসভবনের বসার ঘরে একটি ডেমো স্টুডিও তৈরী করেন যা দেখে এনইসি বুঝতে পারে এই লোকই পারবে একটি দেশের পূর্ণাঙ্গ টেলিভিশন চালাতে।
সাহসের সাথে জামিল চৌধুরী তার নিজস্ব কয়েকজন কৃতিমান বাঙালীর সমন্নয়ে ঢাকার সবচেয়ে উঁচু ভবন ডিআইটির নীচতলায় শুরু করলেন একটি pilot tv চ্যানেলের কাজ। ১৯৬৪ সালের ২৫শে ডিসেম্বর এই পাইলট টিভি উদ্বোধন করতে আসেন পাকিস্তানের প্রেসিডেনট আইয়ুব খান, তার সাথে আসেন গভর্নর মোনায়েম খান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পুরো আয়োজন ব্যনার, ফেস্টুন সব ছিল বাংলায় ।রবীন্দ্র সংগীত জারি, সারি ভাটিয়ালী আর ফেরদৌসী রহমানের উদাত্ত্ব কন্ঠের বাংলা গান ছিল পুরো আয়োজনে।
এরপর এই পিটিভি ঢাকা স্টেশন রামপুরা ভবনে স্থানান্তরিত হয়। তবে ডিআইটি তে থাকাকালীন দেশাত্মবোধক, উন্নয়নমুলক, শিশুতোষ এসব অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সীমিত কারিগরীকুশলতায় “মুখরা রমনী বশীকরন” সংসপ্তকের মত প্রডাক্টশন তৈরী করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন জামিল চৌধুরীর টিমের মোস্তফা মোনোয়ার ও তাদের কলাকুশলী।
১৯৭১ সালে অগ্নিঝরা মার্চ মাসে পিটিভি না বলে ঢাকা স্টেশন বলা হতে থাকে মহাপরিচালক জামিল চৌধুরীর নির্দেশ । ২৩ শে মার্চ সিদ্ধান্ত হয় ঢাকা স্টেশনে পাকিস্তান জিনদাবাদ বলা হবেনা বা ঐ পতাকাও উত্তোলন হবেনা । সেরকম হলোও, কারন অসম্ভব কে সম্ভব করাই ছিল জামিল চৌধুরী ও তার টিমের লক্ষ্য । সেই সাহসে বলিয়ান ছিলেন জামিল চৌধুরী ।
এর পর আসে মুক্তিযুদ্ধ। জামিল চৌধুরী চলে যান ওপারে । যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে বিটিভিকে ঢেলে সাজান। বাংলার সংস্কৃতি, প্রমিত বাংলার প্রশিক্ষন, প্রচলন ও তার প্রসারই শুধু নয়, বাংলায় চেক লেখার মত দুরুহ কাজও তিনি প্রচলন করেন বিটিভিতে।
বাংলা একাডেমি থেকে একটি বাংলা অভিধানও তিনি প্রকাশ করেন। তার বহু ডকুমেন্টেড কীর্তি রয়ে গেছে অন্তরালে তবে যারা জানেন তারাই বুঝবেন এই মহিরুহ ছিলেন বলেই মালয়েশিযার কুয়ালালামপুরে গড়ে উঠেছিল সংবাদ ব্যক্তিত্ব হুমায়ুন চৌধুরির তত্বাবধানে AIBD, NIMCO এবং আরো অনেক কিছু । যার কথা এতক্ষন বললাম সেই জামিল চৌধুরী তার সেই প্রিয় মাতৃভুমি থেকে হাজার হাজার মাইল দুরে কানাডার টরনটো শহরে একেবারেই নিভৃতে বসবাস করছেন ।
এই ২০২৪ শে তিনি ৯০ বছরে পা দিলেন । আজ আমি যেখানে দাডিয়ে আঁছি সেখানে তার কন্যা ও তার পরিবার । খুব অল্প সংখক মানুষের উপস্থিতিতে উদযাপিত হয় সর্বজন শ্রদ্ধেয় গনমাধ্যম গুরুর এই ৯০ তম জন্ম তিথী। পরিবেশিত হয় তার প্রিয় খাবার চাইনিজ ফুড। ১৯৭৫ সালের পর তিনি আর বিটিভি তে যাননি, শোনা যায় ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ৩রা নভেম্বর সিপাহী বিদ্রোহের অরাজকতার সময় ঘাতক দল বিটিভিতে যায় জামিল চৌধুরী এবং মোস্তফা মোনোয়ার সহ বিটিভির আরো কয়েকজনকে হত্যার উদ্দেশ্যে । কিন্তু ঐ দিন কর্মস্থলে না যাবার কারনে তিনি ও মোস্তফা মনোয়ার প্রানে বেচে যান। কিনতু এ দুঃখ আর বেদনা তিনি মেনে নিতে পারেরন নি । তাই পদার্থ বিদ্যার আগের শিক্ষকতার পেশায় তিনি ফিরে যান।
একবার কেবল বহু অনুরোধে বিটিভির ৫০ তম জন্মবার্ষিকির উদযাপনে তাকে নেয়া সম্ভব হয়েছিল যার স্মরণিকায় তার একটি লেখাও ছাপা হয়েছিল। এর মাঝে স্ত্রী বিয়োগের পর তিনি কন্যার কাছে চলে আসেন । আসছে ২৫শে ডিসেম্বর বিটিভির ৬০ তম জন্মদিবসে জামিল চৌধুরী দুরে বহু দুরে, তবে আশা করবো বিটিভির ৬০ তম পূর্তি দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার গনমাধ্যমের পথিকৃত জামিল চৌধুরীর নামেই উৎসবটি অনুষ্ঠিত হবে।
-বাংলাদেশ টেলিভিশন এর সাবেক জনপ্রিয় সংবাদ পাঠিকা।
//এল//