সংগৃহীত ছবি
দিনাজপুরের ফুলবাড়ী পৌর এলাকার পূর্ব গৌরীপাড়া এলাকার তমাল হোসেনের জমিতে বোরো চারা রোপণ কাজ করছেন ১১ জনের একদল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী কৃষি শ্রমিক।
বোরো চারা রোপণ কাজে সবাই খুব ব্যস্ত সময় পার করছেন। এসময় কথা হয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী কৃষি শ্রমিক শ্যামলী মুর্মু (২৮), রুফিনা হাঁসদা (৩০), নির্মলা মার্ডি (৩৮), আরতি সরেন (৪৪), জুলিয়ানা মার্ডি (৪২) বাসন্তি সরেন (৩৫), লিলিনা মুর্মু (৩৬), গোলাপী বেসরা (৩৮), গোরতি কিস্কু (৩৪), চিনিমন সরেন (৩৬) ও লিলিয়ানা হেম্ব্রমের সঙ্গে।
তারা সবাই পার্শ্ববর্তী বিরামপুর উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের বুচকি আদিবাসীপাড়ার বাসিন্দা। কৃষক তমালের ৬ বিঘা জমিতে বোরো চারা রোপণের চুক্তি নিয়েছেন তারা। তাদের ১১ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী শ্রমিকের একটি দল রয়েছে। ওই দল নিয়ে তারা কাজে যোগ দিয়েছেন। সকাল সাড়ে ৯টায় থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত কাজ করবেন তারা। এরমধ্যে দুপুরে গৃহস্তের সাথে চুক্তি হয়েছে দুপুরে নাস্তা বাবদ জনপ্রতি ২০০ গ্রাম করে মুড়ি দেবেন। আর কাজ শেষে মজুরি দেবেন জনপ্রতি ৩৫০টাকা।
এসব নারীরা সবাই বাড়ির গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি অন্যের জমিতে কাজ করেন। যা উপার্জন করেন, তা দিয়ে তাদের সংসার চলে না। বাড়ির কাজের পাশাপাশি দিনমজুরি চুক্তিতে অন্যের জমিতে তারা কৃষি কাজ করেন। কঠোর পরিশ্রম ও উপার্জনে সংসারে পুরুষদের চেয়ে তাদের অবদান কোন অংশেই কম নয়। কাজের মান ও পরিশ্রমের দিক দিয়েও সমানতালে তারা কাজ করেন।
এতোকিছুর পরেও সমাজে সে অনুযায়ী মর্যাদা, পারিশ্রমিক পান না তারা। শিক্ষা, চিকিৎসা, সামাজিক মর্যাদা, পারিশ্রমিক সবকিছুতেই পিছিয়ে আছেন তারা। পরিশ্রম, কাজের মান ও দক্ষতা সমান থাকলেও কোন দিক থেকে তারা পিছিয়ে রয়েছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তাদের সকলের উত্তর একই। কাজের মান ও কর্মদক্ষতায় নয়, নারীরা পিছিয়ে শুধুমাত্র মানসিকতায়। আর মানসিকতায় পিছিয়ে থাকার কারণেই বেতন বৈষম্য রয়েছে নারী-পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে। সমান কাজ করেও বৈষম্য রয়েছে মজুরিতে।
অনেক সময় অর্ধেকে নেমে আসে এই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী শ্রমিকদের বেতন। সংসারের যাবতীয় কাজ সামলানো, ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠানো, রান্না করাসহ বাড়ির সব কাজ বজায় রেখে কাজে যেতে হয় তাদের। প্রায় সমান সময় ও পরিশ্রম দিয়ে কাজ করলেও বেতন বৈষম্যের চরম ক্ষোভ তাদের মাঝে। এর জন্য তারা দায়ী করেন, মহাজনদের মানসিকতাকে।
ধান-গম কাটা ও লাগানো, জমি নিড়ানি দেয়া, ধান মাড়ার কাজ করেন নারী শ্রমিকরা। ধান কাটা ও লাগানোর মৌসুমে পুরুষ শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৫০০-৫৫০ টাকা হলেও নারী শ্রমিকরা পাচ্ছেন ৩৫০-৪০০ টাকা করে। অথচ একসঙ্গে একই সময়ে একই কাজ করেন নারী-পুরুষ শ্রমিকরা।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারী কৃষি শ্রমিক জুলিয়ানা মার্ডি (৪২) বলেন, সকালে ঘুম থেকে উঠেই ঘর পরিষ্কার করার পর রান্না করেন। তখনও স্বামীরা ঘুমিয়েই থাকে। এরমধ্যে রান্না শেষে ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পরে নিজে খেয়ে সকাল ৮টার মধ্যেই জমিতে কাজ করতে বেরিয়ে পড়েন। কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা বেজে যায়। বাড়ীতে এসেই রাতের রান্নার কাজে হাত দিতে হয়। এই গোষ্ঠীর আরেক নারী কৃষি শ্রমিক বাসন্তি সরেন (৩৫) বলেন, বিকল্প কোন উপায় না থাকায় পুরুষ শ্রমিকদের সাথে কম পারিশ্রমিক নিয়েই কাজ করতে হয়। অথচ এতো কাজ বা পরিশ্রম করেও নিজেদের ন্যায্য অধিকার পায়না। পুরুষরা যতটুকু কাজ করেন তারাও ঠিক ততোটুকুই কাজ করেন। কিন্তু মজুরি পান অনেক কম। এ ব্যাপারে তাদের দিকে কেউ নজর দেয় না।
আরও এক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী কৃষি শ্রমিক গোলাপী বেসরা (৩৮) বলেন, কৃষি কাজ করতে আমাদের জীবনটাই শেষ হয়ে গেল। অভাবের সংসার তাই বাধ্য হয়েই স্বামীদের সঙ্গে কৃষি জমিতে কাজ করতে হয়। তারপরেও ঠিকমতো কাজ পান না। স্বামী ও আমাদের মিলে উপার্জন করা টাকায় সংসার চলে। এতো কঠোর পরিশ্রমের পরেও কোন উন্নতি হয় না তাদের। খাটতে খাটতে এভাবেই দিন চলে যাচ্ছে।
জমির মালিক পূর্ব কাঁটাবাড়ী গ্রামের কৃষক হিরেন্দ্র নাথ বর্মন ও আলাদিপুর ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামের মহিদুল ইসলাম বলেন, পুরুষ শ্রমিকদের মতোই নারী শ্রমিকরাও একই সময়ে কাজ শুরু করে। একই সময়ে শেষ করে। তাদেরকে দেখে কষ্ট লাগে। আদিবাসী নারীরা খুবই পরিশ্রমী। তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করছি। কারণ তারা খুবই অসহায়। এভাবেই তাদের বেতন বৈষম্য চলে আসছে, তাই আমরাও কম পারিশ্রমিক দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছি।
নারীদের সমঅধিকার আজও বাস্তবায়ন হয়নি উল্লেখ করে উপজেলা মহিলা পরিষদের সভানেত্রী ও ফুলবাড়ী শহীদ স্মৃতি আদর্শ কলেজের প্রভাষক চন্দনা রানী বলেন, বৈষম্য দূর করতে পুরুষের এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে নারী শ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়ন হবে না। নারীর ওপর অন্যায় করা হচ্ছে। মজুরি বৈষ্যম দূর করার জন্য সব স্তর থেকে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রুম্মান আক্তার বলেন, কৃষিকাজের সর্বত্র নারীদের অবাধ বিচরণ। চারা রোপণ, আগাছা পরিষ্কার, ধান কাটা-মাড়াই, পাটের আঁশ ছাড়ানো, পাটকাঠি শুকানোর কাজ নারীরা করেন। কাজের তুলনায় নারীকে মজুরি কম দেওয়া হয় বলে শোনা যায়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মজুরি বাড়ানো দরকার। না হলে নারীরা কৃষিতে আগ্রহ হারাবেন।
//এল//