সংগৃহীত ছবি
সরকার আসে সরকার যায়,সময় বদলায়,দেশের সব খানেই পরিবর্তনের ছোয়া লাগে। কিন্তু বদলায়নি দেড় লক্ষ চা শ্রমিকদের ভাগ্য।
যুগের পর যুগ দাবী নিয়েই ঘুরতে হয় দ্বারে দ্বারে দেশের এ সব চা শ্রমিকদের। শ্রমিক শ্রেণির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত এ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে এ যাবত কোন সরকার কার্যকর কোন উদ্দোগ নেয়নি।
ফলে চা শিল্প যেমন ধ্বংসের পথে এগুচ্ছে, তেমনি চা শ্রমিকরা ও চরম মানবেতর জীবন যাপন করছে।
তথ্য অনুসন্ধানে দেশের ১৬৬ চা বাগানের মধ্যে বিভাগের ১৪৩ চা বাগানে কর্মরত দেড় লক্ষ শ্রমিকদের অবর্ননীয় দূর্ভোগের চিত্র ফুটে উঠেছে।
চলিত সপ্তাহে দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সব চেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দূর্গাপূজা পালিত হয়েছে। সারা দেশে ঘটা করে সমষ্টিগত ও ব্যক্তিগত ভাবে মন্ডপ সাজিয়ে ভোজের আয়োজন করা হলে ও চা বাগান গুলোতে ছিলো এক বেদনার সুর। বাশ বেত দিয়ে মন্ডপ তৈরি করে কোন রকম দুচারটি বাতি জালিয়ে এ বড় উৎসবে শরীক হয়েছিলেন। চা শ্রমিকরা পূজা উপলক্ষে তাদের বেতনতো বাড়েইনি, বোনাসের গন্ধ ও পান নি।
অথচ তাদের শ্রমেই ঠিক আছে দেশের এ বৃহৎ শিল্পটি। এভাবে অবজ্ঞা চলতে থাকলে এক সময় শ্রমিকরা বিকল্প পেশা বেচে নিতে বাধ্য হবে। সংকটে পড়বে দেশের চা শিল্প।
সিলেটের লাক্কাতোড়া চা বাগানের শ্রমিকরা জানান, ভোরবেলাতেই ঘুম থেকে উঠতে হয় তাদের। একমুঠ মুড়ি আর এক কাপ চা খেয়ে কাজে নেমে পড়েন তারা। কাঠফাটা রোদে দিনভর সংগ্রহ করেন চা পাতা। দুপুরে এক ফাঁকে চা পাতার চাটনি মেখে খান ভাত, কখনো সঙ্গে থাকে মুড়ি কিংবা চানাচুর। এভাবেই কাটে তাদের জীবন। বৃষ্টিতে ভিজে, খালি পায়ে, জোঁক আর বিষাক্ত সাপের সঙ্গে যুদ্ধ করে চা বাগানকে আঁকড়ে জীবন পার করছেন তারা। সবুজ কুঁড়িবেষ্টিত চা বাগানের সীমানাতেই আটকে আছে তাদের জীবন।বংশ পরম্পরায় যে জমিতে চা শ্রমিকরা বসবাস করেন, সেই জমির ওপর কখনোই মেলে না অধিকার। তাই মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু ধরে রাখতে হলে পরিবারের কাউকে না কাউকে বাগানে কাজ করতেই হয়। দিনশেষে ২৩ কেজি পাতা তুললেই তবে পূরণ হয় মাথাপিছু লক্ষ্যমাত্রা। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেই তবে ‘হাজিরা' হিসেবে গণ্য করা হয়। গাছ ছাঁটার সময় সারা দিনে অন্তত ২৫০টা চা গাছ ছাঁটতে হয়। কীটনাশক ছিঁটানোর বেলায় সারা দিনে অন্তত ১ একর জমিতে কীটনাশক ছিঁটানোর লক্ষ্যমাত্রার বোঝা কাঁধে নিয়ে কাজ করতে হয় তাদের। প্রত্যেক বছর শ্রমিক দিবস এলে ঘটা করে পালন করা হয় দিনটি। কিন্তু চা বাগানের শ্রমিকরা তাদের জীবনচক্র আটকে ফেলেছেন চা বাগানের গণ্ডির মধ্যেই।৫০ ভাগ সুবিধাও পান না শ্রমিকরা: নিপেন
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট ভ্যালীর সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, "শ্রমিকদের যে সুবিধা দেওয়ার কথা, তার যদি ৮০ ভাগও শ্রমিকরা পেতেন, তাহলে শ্রমিকদের জীবন বদলে যেতো। এখন ৫০ ভাগ সুবিধাও পান না শ্রমিকরা। শ্রমিকদের জীবন বদলে দেওয়ার জন্য আমরা সংগ্রাম করে যাচ্ছি।”
আমরা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে গত ৮ অক্টোবর শিল্প উপদেষ্টার সাথে দেখা করেছি। আমাদের চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনসহ
বেশ কয়েকটি দাবি তুলে ধরছি। আশা করছি উপদেষ্টা মহোদয় সহ সংশ্লিষ্টরা আমাদের ভাগ্য উন্নয়নে বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
তিনি বলেন, "পৃথিবীর কোথাও এমন মজুরিতে কাজ করা শ্রমিক আছে বলে মনে হয় না। ঝড়-বৃষ্টি কোনো কিছুকে পাত্তা দেওয়া যাবে না। মাথায় ছই (ছাতা) আর পেছনে ঝাঁকি নিয়ে বাগানে যেতে হবে। কোনো কিছুই আমাদের পেটে ভাত দেবে না, কুঁড়ি তুললেই তবে ভাত জুটবে। বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে একজন শ্রমিকের মজুরি হিসাব করলে কোনোভাবেই মেলে না।”
আগে শ্রমিকরা ১২০ টাকা দৈনিক মজুরি পেতেন। ২০২৩ সালের আগস্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘অনুগ্রহে' তাদের দৈনিক মজুরি ৫০ টাকা বাড়ে। ফলে তাদের দৈনিক মজুরি দাঁড়ায় ১৭০ টাকায়। মজুরি নির্ধারণ নিয়ে যখন চা শ্রমিকদের আন্দোলন তুঙ্গে, তখন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে শেখ হাসিনা বৈঠক করেন। প্রায় তিন ঘণ্টা বৈঠকের পর শেখ হাসিনা ৫০ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেন।
এর আগে স্থানীয় প্রশাসন ও শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের চা শ্রমিক নেতাদের বৈঠকের পর ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা দৈনিক মজুরি ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু শ্রমিকদের একটি অংশ তাতে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও বেশিরভাগ শ্রমিক তাতে রাজি হননি। পরে ৫০ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। সর্বশেষ ২০২০ সালে যখন চা শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাগান মালিকদের সংগঠন চা সংসদ মজুরি নিয়ে চুক্তি করেছিল, সেই সময় মজুরি বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি।
প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ ভারতের বাংলাদেশ অংশে প্রথম বাণিজ্যিক-ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয় সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে, ১৮৫৪ সালে। বাংলাদেশ চা উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, দেশে চা বাগান রয়েছে ১৬৭টি। এর বড় অংশটি সিলেট, হবিগঞ্জ এবং মৌলভীবাজার এলাকায় অবস্থিত। এসব বাগানে এক লাখ ৪০ হাজারের মতো শ্রমিক রয়েছে।
//এল//