ফাইল ছবি
আমার এই গোটা জীবনের সাথে রেল গাড়ির বেশ অদ্ভুত একটা যোগাযোগ রয়েছে। নিতান্ত কাকতালীয়ভাবে হলেও সারাজীবন আমি রেল লাইন বা রেলওয়ে স্টেশনের আশেপাশে বসবাস করে চলেছি। জন্ম হলো বগুড়া শহরের রেলস্টেশন লাগোয়া একটা পাড়ায়। সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি রেলগাড়ির পু ঝিক ঝিক, কর্ণ বিদীর্ণ করা রেলগাড়ির হুইসেল, স্টেশনে অজস্র মানুষের কোলাহল, ফেরিওয়ালার হাঁকডাক এইসব নানাবিধ শব্দ পুঞ্জকে সাথী করে কখন যেন বড় হয়ে গেলাম। ঝরে গেল মুকুলিত শৈশব, পা দিলাম বিকশিত কৈশোরে। তবু অনিবার কানে বেজে গেছে পু ঝিক, ঝিক। ছাদে দাঁড়ালে দেখা যেত অনতিদূরে রেল গাড়ির সারি। ঠিক যেন কেন্নো পোকা রেল লাইন ধরে এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছে। এইসব দেখাশোনার মাঝেই কখন পৌঁছে গেলাম কুসুমিত তারুণ্যে। উচ্চমাধ্যমিকের পর লেখাপড়ার জন্য চলে এলাম ঢাকায়। ভাবলাম এই ঘিঞ্জি নগর জীবনে রেলপথ আমায় পরিত্রাণ দিল। কিন্তু বুকের মধ্যে কিসের সূক্ষ্ম ব্যাথা! রেলের হুইসেল ততদিনে আমার কাছে শ্যামের বাঁশী। তারে না পারি ছাড়িতে, না পারি ধরিতে। সে বাঁশীর সুর আর পৌঁছবেনা আমার নতুন আবাসে, নিশ্চিত ছিলাম। কিন্তু না, বিধি সহায়। আবার বসবাস শুরু হলো রেললাইনের সাথে নৈকট্য বজায় রেখে। মহাখালী রেল লাইন ক্রস করে একটু এগিয়ে। বাড়ি বসে কান পাতলে মৃদু একটা রেল চলাচলের শব্দ ঠিকই পাওয়া যেত। এরপর সংসার হল। ভাবলাম আর বুঝি রেলগাড়ির সাথে সংযোগ ঘটবে না। চিরজনমের মত এবার ছাড়াছাড়ি হয়েই গেল। ওমা কি সে কি? পাকেচক্রে বসবাস শুরু করলাম মগবাজারে। সেই রেল লাইন পেরুতে হতোই।
বাচ্চাদের স্কুলে আনা নেয়ার পথেই পড়ত কারওয়ান বাজার রেল ক্রসিং। আবার রেল গাড়ির পু ঝিক ঝিক। আবার পারাপারের অপেক্ষায় রেলের ঘুমটির একদিকে বসে থাকা। দিন গড়াতে গড়াতে এবার ‘বেলা যে পড়ে এলো, জলকে চল’। বহুদিন হলো বসবাস ধানমন্ডিতে। নাহ্ এবার আর কোন পু ঝিক ঝিক নাই। কান ফাটানো হুইসেল নাই। লাল রংএর অলস স্বভাবের মালটানা বগি নাই। দৃষ্টি সীমায় নাই এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলা ধাতব পথ। বেশ কেটে গেল অনেকগুলো বছর। ভুলতে বসেছি রেলের ঘণ্টি।কিন্তু বিধার বিধান খন্ডায় কে? আবারও যেন দীর্ঘ নিদ্রার পর আচমকা জেগে উঠলাম। ফিরে এলো রেলের দিন। ফিরে এলো নতুন অবয়বে।
রেললাইন, রেল গাড়ি, রেলের বগী সবটুকু নিয়ে এক নতুনের আবাহন ।একেবারে আনকোরা, নতুন মোড়কে মোড়া অত্যাধুনিক স্কাই ট্রেন বা মেট্রো রেল। এর কোন পু ঝিক ঝিক নাই। নাই তার হেলে দুলে একটানা ধীরলয়ে চলার গতি। এর বহরে নাই কোন লাল রংয়ের রেললাইন জুড়ে রোদ পোহাবার ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা মালগাড়ি। তবে যন্ত্রের আকুলতা তো আছেই। আছে আকাশ ফুঁড়ে ঝড়ের গতিতে ছুটে চলার মার্জিত ধ্বনি। তাই এখানেও কান পাতলে একটা মৃদু রেল চলাচলের শব্দ শোনা যায়।ক্ষীণ, তবে তীব্র সে চলার গতি। অনুভব করি নতুন দিনের জয় যাত্রা। নবীন পাতার মত সবুজ, সতেজ এক নতুন বিস্ময়। মাথার উপরে দুর্জয় গতিতে ছুটে চলেছে নতুন প্রজন্ম। তার তলদেশ দিয়ে অতি পুরাতন জীর্ণ জীবন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে পথ পাড়ি দেয়। সে এক আশ্চর্য কাণ্ড বটে! সে এক চমৎকার!
এই ঝা চকচকে পরিমার্জিত রেলের আগমন কি আমায় ভুলিয়ে দিতে পেরেছে অতীতের সেই দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত আর তারই গা ঘেষে সর্পিল ভঙ্গিতে এগিয়ে চলা পুরানো রেলপথ? ভুলে গেছি কি পুরানো লাল ইঁটের গাঁথুনীর মলিন চেহারার রেলস্টেশনটি? যার সুউচ্চ ছাদটি ছিল পলেস্তারা খসা এবড়ো থেবড়ো চেহারার। সেই খসে পড়া পলেস্তারার ফাঁক ফোকর দিয়ে দাঁত খিচিয়ে থাকতো মেঘ গম্ভীর স্টীল বীমগুলো। অন্ধকার, ঘুপচি স্টেশন মাস্টারের ঘরটা, ভুলে গেছি কি মরচে পড়া শিকের সূর্য আকৃতির টিকেট কাটার ঘুলঘুলি। যার অন্য প্রান্তে প্রায়ান্ধকার ঘরে বসে থাকা ক্লান্ত টিকেট বিক্রেতার চোখদুটি বড্ড জ্বলজ্বল করত।
কি করে ভুলে যাবো সেই সুদূরে ফেলে আসা ধূসর অতীত। বিস্মরণের ওপার থেকে এখনও যে কানে বাজে পুরানো সেই সুরে কে যেন ডাকে দূরে কোথা সে ছায়া সখী, কোথা সে জল। ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
ইউ