প্রতিকী ছবি
আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি
সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ।
তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি,
তাহার গানে নাচে আমার বুক।
কবি গুরুর চরণ দু'টি স্মরণ করিয়ে দেয় একদা আমাদেরও এমন একটি সামাজিক জীবনাচার ছিল। তোমার সুখে আমি সুখি হব, তোমার দুঃখে আমি কেঁদে বুক ভাসাব। এমনই একটি অলিখিত আত্মীয়তার বন্ধনে বাঁধা ছিল একই পাড়ায় বসবাসকারী কিছু পরিবার। সে বাঁধনের দৃঢ়তায় ঘুচেছে রক্তের বন্ধনের ফারাকটুকু।
সেইসব যাপিত জীবনের একেকটি ক্লান্তিকর দিনের উপশম ঘটেছে পড়শিবাড়ির উঠানে। এ বাড়ির দুঃখ লাঘব হয়েছে ও বাড়ির অলিন্দে। ও বাড়ির আনন্দের ঢেউএ ভেসে গেছে এ বাড়ির দোর জানালা। সে এক সময় ছিল বটে। দিনের রোদ টুকু পশ্চিমে ঢুলুঢুলু হতেই প্রতিবেশী বন্ধুটির জন্য মা, চাচিদের মন উচাটন। কাজ শেষে ঘরে ফিরে বাবার মনে পড়েছে পাশের বাসার ছেলেটার জ্বর। যাই একটু দেখে আসি। বা আরেক ঘরের বিবাহযোগ্য মেয়েটির জন্য একটি ভাল সম্মন্ধ এসেছে। মেয়ের বাবাকে জানিয়ে আসি সুখবরটি।
পাড়াবেড়ানোর আনন্দটি একটি অতীত অধ্যায় প্রায়। প্রায় অচেনা একটি শব্দ। এর বিপুল তৃপ্তিদায়ক ক্ষমতাটি নিক্ষিপ্ত হয়েছে কালের বিবরে।
মনের মধ্যে কত স্মৃতির কোলাজ। গরমের বিকালে পরিষ্কার কাপড় পরে গায়ে গাদাগুচ্ছের কিউটিকোরা ঢেলে মুখে একটি সাজানো পান গুঁজে মা চললেন পাড়া বেড়াতে। ওমুক চাচি, তমুক মামীর বাড়ির উঠান তোলপাড় করতে মায়ের সাথে সাথে ছানাপোনারও হাঁটা ধরল। তারপর সেখানে পৌঁছে সেবাড়ির ছোটদের সাথে ছানাপোনারা জুড়ে দিল হৈহল্লা। আর মায়েরা, তাদের তো কথার শেষ নেই। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, তাদের সামনে রাখা চায়ের কাপ ততক্ষণে পিঁপড়াদের দখলে, কিন্ত এইসব গৃহবধূদের কথার আদান প্রদান যেন আর শেষই হয়না। তবে বাড়ি তো ফিরতেই হবে। দিনের আলোর শেষ রেশ টুকু মুছে এলে সংসারে ফেরার তাড়া। নিতান্ত অনিচ্ছায় তাই আড্ডা ভেঙ্গে উঠে পড়তে হয়েছে। তারপর যে যার সংসারে আবার যোদ্ধার ভূমিকায় ফিরে গেছেন। সাথে করে নিয়ে গেছেন একটি নিটল মন। মনটি যেন তখন জলটলটল স্নিগ্ধ পদ্মদিঘি। প্রতিবেশী বন্ধুটির কাছে নানান সুখদুঃখের ঝুলি উপড়ে দিয়ে তারা তখন পালকের মত হালকা। জীবনের ভার এমনি করেই লাঘব করে আবার নতুন বোঝা বইবার শক্তি সঞ্চিত হয়েছে এইপথেই। দিন বদলের পালায় ঝাপসা হয়ে এলো সেই সব মুখরিত মূহূর্তগুলো। আহা স্মৃতিগুলো যেন এখন শুধুই কিংবদন্তি। কেবল মনের অন্ধি সন্ধিতেই তাদের বাস। বাস্তবে প্রতিবেশী শব্দটি সুদূর অতীতে হারিয়ে যাওয়া একটি অধ্যায় মাত্র।
হারিয়ে গেছে সেই সব উঠানজুড়ানো গৃহকোণ। নগরের ইঁটের পাঁজায় চাপা পড়ে বিবর্ণ এখন সবুজ ঘাসেরা। এ শহরে জোনাকীর পাখায় ভর করে সন্ধ্যা নামেনা। কামিনীর গন্ধ গায়ে মেখে প্রলম্বিত হয়না সাঁঝের আধো আলো।
প্রতিবেশীকে সমাদর করতে তাই আমরাও হয়েছি অপারগ। একেকজন সেঁধিয়ে গেছি স্কয়ারফিটের ঘেরাটোপে। ভিষণ একা এবং নিসংঙ্গ এক নগরজীবনের ঘোড়দৌড়ে কখন যেন তলানিতে ঠেকে গেল পড়শির সাথে কুশল বিনিময়ের সময়টুকুও।
নিতান্ত দুয়ার লাগোয়া প্রতিবেশী তাই সৃষ্টি করে চলেন নিত্য চমক। সহসা কোন একদিন হয়তো লক্ষ্য করলাম পাশের ফ্ল্যাটের কিশোরী কন্যাটি এখন সদ্য যৌবনা। অথবা দৃশ্যমান হয়েছে প্রতিবেশীর বালক সন্তানটির ঠোঁটের উপরে হালকা গোঁফের রেখা। হায় কবে এলো এত পরিবর্তন! খবর রাখিনি। পাশের ফ্ল্যাটে হঠাৎ মৃদু কান্নার আওয়াজে জানতে পারি সেবাড়ির বয়োবৃদ্ধ সদস্য গতরাতে অকস্মাৎ ইহলোক ত্যাগ করলেন। অথবা উচ্চ গ্রামে বেজে চলা হিন্দী গানের কানফাটা শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে আবিস্কার করলাম সেটি আসলে প্রতিবেশীর ঘরে বেজে ওঠা বিয়ের সানাই এর নব্য সংস্করণ।
খবর রাখিনি আমার সুপ্রিয় প্রতিবেশীটি দীর্ঘ রোগ ভোগে বিপর্যস্ত। বা তার সন্তানের অসামান্য সাফল্যের আনন্দভাগ থেকে আমার পাওনা টুকু আর আদায় করা হয়ে ওঠেনি।
এক একটি আত্মকেন্দ্রিক দিনের শেষ থেকে শুরু অবধি প্রতিবেশীর সাথে ভাববিনিময়ের সুখানুভূতিহীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত আধুনিক সমাজ। মেকি আধুনিকতার মোড়কে চিড়েচ্যাপ্টা মনগুলো ধরফড়িয়ে মরে, তবু পড়শি গৃহে একটু উঁকি দিতেও অস্বস্তি, আরষ্ট মন সায় দেয়না অন্যকে বিরক্ত করতে। মনকে গুটিয়ে খোলসে ভরে রাখি সেও ভাল, কিন্তু ভুলেও প্রতিবেশীর কাছে তাকে অবমুক্ত করতে যেন পাহাড় সমান দ্বিধা। দুয়ার এঁটে দিন কাটে। দিন কাটে সঙ্গীহীন, বন্ধুহীন একাকি। নিসংঙ্গতা কাটাতে ঘন ঘন ফেসবুক স্ক্রল করে মন ও চোখের নিরন্তর স্বাস্থ্যহানি ঘটিয়ে তবে কি বেশ আছি আমরা? ভালো আছি তো?
ইউ