ফাইল ছবি
স্নিগ্ধ গোলাপি রং ছড়ানো কাঁচের গ্লাসে রূহ-আফজাহ’র শরবৎ। টেবিলে সাজানো আকারে বড় আরবীয় খেজুর। অন্যান্য ইফতার সামগ্রীর পাশাপাশি ছোলা, পেয়াজু, বেগুনী, হালিম সহ দেশীয় কায়দায় ইফতারের পশরা। সাঁঝের বাতাসে কোরআন তেলওয়াতের সুর। কিছুক্ষণ পর আজান হবে তার অপেক্ষা। ইফতার সাজিয়ে আমরা জনা পাঁচেক মানুষ অপেক্ষা করি রোযা ভাঙ্গার সময়ের। এবারের রমজান মাস কেটেছে অনেকটা সেকালের কিশোরী বেলার সময়ের মতো। আম্মার উপস্থিতির কারণে। পনেরো বছর পর আমার আম্মা বেড়াতে এসেছেন আমার বাসায়, সিডনীতে। আমেরিকা-কানাডা তার অন্যান্য ছেলেমেয়েদের কাছে যাওয়া আসার কারণে সিডনীতে আসাটা কিভাবে কিভাবে যেন অনেক বছর পেরিয়ে গেলো!
অভিবাসী জীবনে পরিযায়ী মানুষ গুলোর শিকড় গাঁথা তার শৈশবের অলিতে-গলিতে। নতুন আবাসের দৈনন্দিন জীবনকে মানিয়ে নিতে হরেক রকম পরিবর্তনকে মেনে নিলেও কারণে অকারণে ফিরে যায় শৈশবের স্মৃতির সেই গচ্ছিত চত্বরে। আম্মাকে পেয়ে আমার সেরকম উচাটন মন ঘুরে ফিরে সারাক্ষণ-নস্টালজিয়ার কাছে। গতানুগতিক চলমান পরিবৃত্তে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া জীবন যেন ক্ষণিকের জন্য ফিরে গেলো বুনিয়াদী স্তরের সেই সেকেলে জীবন ধারায়। আম্মা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে উঠেন শেষ রাতে। তখন গরম ভাত চড়ান চুলায়। আমার ঘড়িতে এলার্ম দেয়া থাকলেও আম্মার ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গে সেহরি খাবার। ঘুম ভাঙলেই ধোঁয়া উঠা গরম ভাতের ঘ্রাণ পাই নিচের রান্নাঘর থেকে। ভোররাতে সেহরির জন্য কখনো ধোঁয়া উঠা ভাত রাঁধা হয়নি আমার এই পরবাসী জীবন ধারায়। নীচে নেমে টেবিলে আসতেই দেখি ইতিমধ্যেই টেবিলে ভাত তরি-তরকারি সব তৈরি। ঠিক যেমনটি কৈশরবেলায় করা থাকতো। আমরা মুখ হাত ধুয়ে টেবিলে বসতেই সবার প্লেটে ধোঁয়া উঠা ভাত বেড়ে দেন আম্মা নিজ হাতে। এটা তার নিত্যকার স্বাভাবিক অভ্যাস। সাথে থাকে সনাতনী তারকারির নানা পদ। এই যেমন নারকেল দিয়ে কলার খোসার ভর্তা, ইলিশ মাছ দিয়ে কাঁচা কলার তরকারি, পাঁচফোড়নের কুমড়া সব্জি, কচু দিয়ে চিংড়ি মাছ, ঝিঙ্গে ভাজা, এরকম আরও কতো কি! এসব খাদ্য খাবারের কথা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। সেহরির শেষপাতে আবার দুধ কলা আর পাটালি গুড় দিয়ে খাবার পর্ব সমাপ্ত করেন। ধুলোপরা মগজের ভাজ থেকে এসবের স্মৃতি বিলীন হয়ে যাচ্ছিলো প্রায়। আম্মার পরিচর্যায় একে একে আবার সব জেগে উঠছে। এরপর সেহরি শেষে চা কিংবা কফি খাওয়া হয়। এটা আম্মা আগেও করতেন। ফজরের নামাজের অপেক্ষা করতে করতে কিছুক্ষণ গল্পগুজব চলে। তারপর নামাজের সময় হলে সবাই ফজরের নামাজ পরে আবার এক চিলতে ঘুম।
সেহরির পর আমার আর ঘুম হয়না। কোন একটা বই নিয়ে বসা কিংবা কাজে যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকি। যদিও রমজান ও আম্মার সম্মানে এবার অনেকটা সময় ছুটিতেই কাটিয়েছি। কিহবে এতো কাজ করে’ এমন একটা মানসিক অবস্থা নিয়ে সময়টা গুছিয়েছি। একটু ভোরের আলো ফুটতেই ব্যলকনিতে দাড়িয়ে দেখি সামনের ও পাশের প্রতিবেশী যারা ছিল তারা বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে। এখানে নেই। নতুন মালিক বাড়ি ভেঙ্গে নতুন বাড়ি করবার সরঞ্জাম নিয়ে আসছে প্রতিদিন। আগে প্রতিবেশীর সাথে আমার খুব আসা-যাওয়া হতো। সময়ে অসময়ে খাবারদাবার, শাক সব্জি বিনিময় ছিল নিত্যকার রুটিন। আজ তারা কেউ আর নেই। মাঝে অনেকগুলো বছর নিজ কমিউনিটি নিয়ে খুব যোগাযোগ বেড়ে যাওয়ায় প্রতিবেশীদের সময় দেয়া হয়নি। খোঁজও তেমন আর নেয়া হয়নি। তারা যে এই ধরাধমে নেই সেটিও জানা হয়নি। হটাৎ একদিন তাদের ছেলেমেয়েদের দেখে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে জানতে পারলাম সামনের তিন প্রতিবেশীর কেউই আর এই দুনিয়াতে নেই। এই জন্যই বাড়ি বিক্রি করে যার যার অংশ টুকু ভাগ করে নিয়ে নেবে। কেমন জানি লাগলো! মর্তের এই জায়গাটুকুতে যারা এতদিন বসবাস করতো, হাঁটা চলা করতো, সামনের লন গুছিয়ে রাখতো তাদের আর কোন অস্তিত্ব নেই এখন। নতুন মানুষ এসে সেটা নিজের বলে দাবী করে আবার নিজের মতো করে সব গুছিয়ে সাজাচ্ছে। এই কোলাহলের পৃথিবীতে আমরা ক’দিনের অতিথি হয়ে এসে কতো কিছুই না করি! সময় শেষে কেউ মাটি, কেউবা ছাই। আমাদের আর কোন চিহ্নই থাকেনা। অথচ আমাদের জীবদ্দশায় আমরা মানুষকে কতোই না মানসিক কষ্ট দেই, অহেতুক যন্ত্রণায় জর্জরিত করে রাখি! এই ক্ষণস্থায়ি সময়ে সেটা বুঝতে বুঝতেই আমাদের চলে যাবার সময় হয়ে যায়।
সকালে নাস্তা খাবার তাড়া নেই বলে অনেকটা সময় পাওয়া যায়। আম্মা ঘুম থেকে উঠে তার অন্য ছেলেমেয়েদের ফোনে খোঁজ খবর নেন। সাথে তার ভাইবোন সহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের ও খবরাখবর নেন। পুরানো স্বজন পরিজন অনেকের কথা আম্মার কাছে জানা হয়। যাদের সাথে আমার শৈশবের কতশত স্মৃতি ছিলো সেইসব আবার নতুন করে উঁকি দেয় মনের গলিতে। আমি যেন আর আমার বর্তমান সময়ে থাকিনা। হয়ে যাই পুরানো পরিবৃত্তের সেকেলে আমি। মফস্বল শহরে বেড়ে উঠা এক নমনীয় কিশোরী। সময়ের স্রোতে কতোটা পাল্টাতে হয় নতুন করে দৃশ্যমান হয় চোখের পাতায়। আম্মাকে পেয়ে এটা সেটা আব্দার করি যেন এটা আমার সংসার না, আম্মার সংসারে আমি। ছোটবেলায় আমাদের জামা কাপড় বানাতেন আম্মা। লেইসফিতা আর ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে প্রিন্টের কাপড় কিনে তাতে নানা রঙের লেস লাগিয়ে ডিজাইন করে ঈদের জামা বানিয়ে দিতেন। সব ভাইবোনদের জামাকাপড় আম্মা নিজেই বানাতেন। এবার আম্মাকে পেয়ে সেলাই মেশিনটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম জামার হাতা, ব্লাউজ, পোশাক ফিটিংস গুলো করে দিতে। আম্মা সাগ্রহে মেশিন চালিয়ে সব করে দিলেন। এসব দেখে ছেলেমেয়ে, গৃহকর্তা সহ সেলাই ছুটে যাওয়া যাকিছু আছে আম্মাকে দিয়ে ঠিক করে দেবার আব্দার শুরু করলো। আম্মাও একে একে সব করে দিলেন। গৃহকর্তা ঈদের ড্রেস হিসেবে ঈদ মেলা থেকে পা-অব্দি এক আরবীয় জোব্বা-আলখাল্লা কিনে এনেছে সেটাও আম্মাকে দিয়ে ফিটিংস করিয়ে নিলো। আম্মা কোন ট্রেনিং ছাড়াই শেলাই করতে পারদর্শী। এটা তিনি খুব আগ্রহের সাথে করতে পছন্দ করেন। এই সুবিধায় আমি আমার ব্লাউজ গুলোও ঠিক করে নিলাম। আম্মা এখনো তার নিজের ব্লাউজ নিজেই বানিয়ে থাকেন।
টুকটাক কাজ করতে করতে ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসে। নানা পরিকল্পনায় ভিন্ন স্বাদের ইফতার বানাতে প্রস্তুতি হয়। সবাই মিলে ইফতারের টেবিল গুছাই একেবারেই দেশীয় আড়ম্বরে। আজানের অপেক্ষা শেষে পারিবারিক নানা কথায় কথায় ইফতার করে পড়ি মাগরিবের নামাজ। নামাজ শেষে আম্মাই আবার সবার জন্য কফি কিংবা চা বানান। আম্মার কারনে এবার চা কফিতে দুধ-চিনি খাওয়া বন্ধ করতে পেরেছি। উনি নিজে ব্ল্যক কফি খান আবার আমাদের জন্য আলাদা করে দুধ-চিনি দিয়ে হবে তাই ভাবলাম আম্মার মতো করেই খাওয়া অভ্যাস করে ফেললেই বরং ভালো। তারউপর বার বার সতর্ক করতে থাকেন চিনি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অগত্যা কি আর করা, বাধ্য হয়ে অভ্যাস বদল। এরপর তারাবী নামাজের জন্য মসজিদে যাবার তাগাদা দিতে থাকেন। গিলফোর্ড আমার বাসা থেকে রাস্তা পেরুলেই দু’দুটো মসজিদ। কিন্তু এতো বছরেও কোনদিন যাওয়া হয়নি। এবার রোজা শুরু হাবার আগের দিন আমরা হেঁটে হেঁটে মসজিদ গুলোর নিয়মকানুন ও নামাজের সময় জেনে এলাম। যেদিন থেকে তারাবী নামাজ শুরু সেদিন থেকেই মসজিদে এশা, তারাবী, ও বিতরের নামাজ পড়লাম সবাই। আমেদের এমন নিয়ম করে যাওয়া দেখে পুত্রকন্যারাও আন্মার সাথে যাওয়া শুরু করলো। তারাবী নামাজ ও যে আয়োজন করে পড়া হতো বহুকাল পর আবার নতুন করে অনুভব করলাম। ওখানে মসজিদের অন্যান্য মহিলা মুসল্লিদের সাথেও আম্মার একটা পরিচিত পরিবেশ তৈরি হল। কখনো তাদের না দেখলে নিজ থেকেই খোঁজাখুঁজি করেন। মানুষে মানুষের এই মোলাকাতের প্রয়োজনীয়তা ভার্চুয়াল জগত ছিনিয়ে নিয়েছে সেই কবেই, সেতো আর নতুন করে বলার কিছু নেই।
রোজার মধ্যেই ইস্টারের লম্বা ছুটি পড়লো এবার। রোজা রেখে দুরে কোথাও যাওয়া হবেনা বলে সেই ছুটিতে আম্মা আমার শ্বশুর বাড়ির পরিজনদের সাথে বেশ ক’দিন থেকে এলেন। ফেরার সময় নারেলীন কবরস্থানে আমার শাশুড়ির কবর যিয়ারত করার জন্য গেলাম সবাই মিলে। এরপর সিডনী শহরে আমাদের স্বজন-পরিজনদের বাসায় ইফতারের দাওয়াতে শরীক হওয়া, লাকাম্বা, অবার্ন, লিভারপুল সহ রমাদান ফেস্টিভ্যালে অল্প সময়ের জন্য দেখে আসার এই পারিবারিক আমেজ বহুদিন হয়ে উঠেনি। যদিও আম্মা আমাদের জন্য সুটকেস ভরা জামাকাপড়, শাড়ি, জুয়েলারি সবই নিয়ে এসেছেন। তবু ঈদ বলে কথা, তাই আম্মাকে নিয়ে লিভারপুল শাড়ীর দোকান আর হুইটলাম সেন্টারের ঈদ মেলা থেকে ঈদের শপিং করলাম। আম্মা নামাজ মিস হবে বলে তেমন কোথাও যেতে চান্ না কিংবা গেলেও বাসায় ফেরার জন্য তাগাদা দিতে থাকেন। আমি আম্মাকে বলি, এই যে নামাজের জন্য এতো আকুলতা, আরবী অর্থ না জেনেই সূরা পড়ে কেবল উঠাবসা করেন তাতে কি আদৌ কি কিছু হবে, বা হয়! আম্মা এসব নিয়ে আমার সাথে কোন আলাপচারিতা বা তর্কে যান না। আমিও ছুটাছুটি কমিয়ে আম্মার ইচ্ছাকে মেনে নিয়ে ঘরে সময় দিলাম। সাংসারিক বিষয়ে গৃহকর্তার সাথে আগে যেমন মতানৈক্য আর বিরোধে সময় নষ্ট হতো আম্মা থাকার সুবাদে দু’জনেই সংযত হবার প্র্যাকটিস করতে হচ্ছে। কলহ-কর্কশতার যে সময় থাকে সংসারে, আম্মার অনুশাসনে সেরকম অনুযোগও তেমনটা আর হচ্ছেনা। সহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধাবোধ আর মানসিক প্রশান্তির জন্য মানুষের সংস্পর্শ ভীষণ প্রয়োজন। আম্মার স্বশরীরে থাকা সেইসাথে রমজানের সহিঞ্চুতার সম্মিলিত প্রভাবে দৈনন্দিন ছুটেচলায় কিছুটা স্থবিরটা এসেছে যাপিত জীবনে। শৈশব-কৈশরের রমজানের আমেজ আর আম্মার পারিবারিক প্রত্তাহিক আলাপচারিতায় স্মৃতি জাগানিয়া সময়ে ফিরে যাচ্ছি বারবার। এবার ঈদের প্রস্তুতি। এখানেও সেই ছোটবেলার, কৈশোর বেলার স্মৃতিবিজরিত সুবাস পেতে আম্মার হাতেই ছেড়ে দিলাম সবকিছু। ঈদের আয়োজন-আইটেম পাকন পিঠা নাকি জর্দা-সেমাই যা করার আম্মাই করুক। এবার আমার ছুটি।
ইউ