প্রতিকী ছবি
সমতল ছাড়িয়ে ক্রমশ উঠে যাচ্ছি ঊর্ধ্বরেখায়। দিকভ্রান্ত পথিক নই। সঙ্গীহীনও নই। তবু আমি ডুবে গেছি একান্ত আমাতেই। চক্রাকার পথ পেরিয়ে যতই উপরে উঠছি ততই নিসর্গ আমায় একান্ত করে বুকে টেনে নিচ্ছে। একপাশে পাহাড়ের ঢাল নেমে গেছে প্রকৃতি সৃষ্ট অতল স্পর্শী খাঁদে। আর অন্য পাশটায় -------- উঃ প্রকৃতি কি অসামান্য নৈপুণ্যে বুনে গেছে এক নিবিড় সবুজের আচ্ছাদন। নাম না জানা অজস্র দীর্ঘকায় সবুজ বৃক্ষরাজির ঠাস বুনটে সৃষ্ট জটিলতায় সে যে অনবদ্য এক অরন্যরূপ। দিনের উজ্জ্বল আলোতেও কিছুটা আবছায়া অন্ধকার সেই শ্যামলিমায় যোগ করেছে সৌন্দর্যের আরো কিছু বাড়তি অনুষঙ্গ। প্রায় পান্ডব বর্জিত সেই চড়াই পথে এক গা ছমছমে রোমাঞ্চকর অনুভূতি। প্রভাতের মৃদু হাওয়ার দুলুনিতে সুবিশাল বৃক্ষরাজি শুকনো পাতা ঝরাচ্ছে। কানে ভেসে আসছে সেই সব ঝরাপাতাদের বিধূর সংগীত।সম্মুখে বেয়ে চলেছে আঁকবাঁকা সরীসৃপের মত কালো পিচঢালা চড়াই উৎরাই।
হঠাৎ দৃষ্টি নিবদ্ধ হল চলতি পথ হতে দূরে, বহুদূরে সীমাহীন উচ্চতায় একঢাল সবুজের মাঝে অকস্মাৎ ভেসে ওঠা একটি ধবধবে সাদা গম্বুজের চূড়ায়। বিস্ময়৷! কেবলি বিস্ময়! এত উঁচুতে একটি ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন মন্দিরের শুচিস্নিগ্ধ শুভ্রতায় মোহাবিষ্ট আমি। মুহূর্তে ভুলে গেলাম দুপাশের বনস্হলী, নাম না জানা লতাগুল্ম, পাহাড়ি বেগুনি, হলুদ বিচিত্র সব রঙীন ফুলেল বিহ্বলতা।
আমি চলেছি একটি ঘন জঙ্গলে ঘেরা পর্যটন কেন্দ্রে। চিয়াংমাই শহর থেকে পাহাড় অরন্যে ঘেরা গাড়ি পথে দু থেকে তিন ঘণ্টার একটি ভ্রমণ। আমার ক্ষীণ স্মৃতিশক্তির কবলে পড়ে গন্তব্যটির নাম বিস্মৃতপ্রায়। তবে সেখানে পৌঁছুনোর যে পথ, তার দুপাশের সৌন্দর্য এখনও মনোভূমিতে সমুজ্জ্বল। দূর থেকে চোখে পড়ছে মন্দিরের চূড়ায় ছলকে পড়া দিনের প্রথম আলোক রেখা। সেই কনকপ্রভায় একটি কংক্রিটের শরীরে যেন প্রাণের স্পন্দন দূর থেকেও অনুভূত হচ্ছে। অভিভূত আমি। চারিধারে নির্বিকার নৈশব্দের মাঝে গাঢ় হরিৎ বনপথে সুদূর উচ্চতায় শান্ত, সফেদদেহী এক ধ্যানমগ্ন মৌন ঋষিতুল্য সেই মন্দিরটি আমায় মুহূর্তে অপার মুগ্ধতায় ভাসিয়ে নিল। পাকদণ্ডী পথ বেয়ে উঠতে উঠতে তার পূণ্যময় সৌন্দর্য কখনও কখনও পাহাড়ের বাঁকে আড়ালে চলে যাচ্ছে। আবার সহসাই ভেসে উঠছে অবারিত সবুজের মাঝে নয়ন জুড়ানো অপাপবিদ্ধ শ্বেতশুভ্র মন্দির মুকুটখানি।
বেশ ক বছর আগে দেখা অনন্ত সবুজের মাঝে এক প্রভাতের নবীন আলোয় উদ্ভাসিত মন্দিরের শুভ্র সুন্দর গম্বুজটি হয়তো এখনও তার স্বমহিমায় তেমনি উজ্জ্বল। এখনও হয়তো সেদিনের মতই নির্মল আকাশ জুড়ে চলে তুলো তুলো মেঘমালাদের সাথে মন্দির চূড়াটির তেমনি লুকোচুরি খেলা। চঞ্চলা প্রকৃতির খেয়ালে হয়তোবা কখনো বর্ষণ সিক্ত হয়ে আরো পবিত্র হয়ে ওঠে। অথবা সোনারোদে ঝিকিমিকি আলোর বিচ্ছুরণে এক শুভ্র বলয়ে রূপান্তরিত হয়। শুধু পান্ডুর হয়েছে এই মহাবিশ্বের শতসহস্র মানবকূলের জীবন প্রণালী। পায়ে পায়ে মৃত্যুর নাগপাশ জড়িয়ে রেখেছে একেকটি অমূল্য মানবিক প্রাণকে।
চিয়াংমাই পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে হয়তো সেদিন অজান্তেই এঁকে রেখে এসেছিলাম আজকের নির্মম ভবিতব্য।
একটি মুমূর্ষু সময়ের ক্রীতদাস হয়ে আজ সমগ্র মানবজাতির সাথে আমিও অদৃশ্য পাকদন্ডি পথে নিরলস মুক্তির পথ খুঁজে ফিরছি। যে পথের প্রতিটি পরতে লুকিয়ে আছে অনাহূত জীবানুর মরণ ছোবল।
জীবনের বাঁকে বাঁকে যতটুকু সুধার সন্ধান পেয়েছি আকন্ঠ পান করে গেছি তা। তাই বুঝি বেঁচে থাকা এত সুখের। মৃত্যুর বিভীষিকায় ক্ষণে ক্ষ ণেকেঁপে উঠি তাই। মৃত্যু অমোঘ জেনেও বলতে পারিনা, "মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান "। জীবন পাত্রখানিও যে অমৃতময়। তাকে দূরে ঠেলে দেবার সাধ্য কোথায়?
মরণ নয় বরং প্রাণের স্পন্দনটুকু কান পেতে শুনবার সুতীব্র আকাংখায় মনের জমিনে অনুরণিত হয়_--
‘আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনি লীলা তব
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।’
পাওয়া না পাওয়ার দ্যোতনাময় এই আয়ুষ্কাল যেন মধুর ভান্ডার। বারে বারে তাই ফিরে দেখার বাসনা জাগে জগতের সমুদয় সুন্দরকে। রুগ্ন ধরিত্রীর বিষাক্ত বায়ু আর নয়, বুকে ভরে নিতে চাই একটি নিরোগ পৃথিবীর কিছু লেবুগন্ধি হাওয়া।
ইউ