নারী অভিবাসী শ্রমিকের অধিকার বিষয়ক সংবাদ সম্মেলন
নির্যাতনের শিকার অভিবাসী নারী শ্রমিক যারা নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরেছেন, তাদের ফেলে আসা উপার্জিত অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নিতে হবে। একজন নারী অভিবাসী শ্রমিকও যেন আর নির্যাতনের শিকার না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। দালালরা তাদেরকে বিদেশে গৃহপরিচারিকার কাজ দেওয়া নিয়ে যে কৌশল অবলম্বন করে তা থেকে নারী অভিবাসী শ্রমিকদের বের করে আনতে হবে। অভিবাসী নারীর অধিকার সুরক্ষায় স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করতে হবে। ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পর্যায়ের প্রতিনিধিদের অবগত থাকতে হবে কারা অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে কোন দেশে যাচ্ছেন, কার মাধ্যমে যাচ্ছেন। সিডব্লিউসিএস’র আয়োজনে এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জ্বল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় নারী অভিবাসী শ্রমিকের অধিকার বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা একথা বলেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আইসিএমপিডির কান্ট্রি কোর্ডিনেটর মোহাম্মাদ ইকরাম হোসেন বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদকে সম্পৃক্ত করে ইউনিয়ন পরিষদে নারী অভিবাসন কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। ডেমো অফিস কে জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং নারীবান্ধব পরিবেশ প্রয়োজন। সরকারের বিভিন্ন সুবিধা আছে, সরকারের নতুন পলিসি উদ্যোগ নিচ্ছে যেমন রিইন্টিগ্রেশন পলিসি। একদম ডোর স্টেপে সার্ভিসগুলো প্রচার করতে হবে।’
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কোর্ডিনেটর মহুয়া লেয়া ফলিয়া বলেন, ‘গণমাধ্যমে বেশিরভাগ খবর নেতিবাচক। ইতিবাচক খবর কম দেখতে পাই । অভিবাসী নারীদের প্রতি শব্দ চয়নে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে তারা অসম্মানিতবোধ ও আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। একটি শব্দ ভাণ্ডার তৈরি করার প্রস্তাবনাও দেন তিনি।’
সিডব্লিউসিএস’র প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইসরাত শামীম বলেন, ‘স্থানীয় সরকারকে অভিবাসনের সকল তথ্য জানতে হবে। অভিবাসী নারীদের ডিজিটাল শিক্ষা বাড়াতে হবে। দেশের বাইরে যাবার আগেই তারা মোবাইল ফোনে ছবি তুলে কীভাবে তাদের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস স্বজনদের কাছে পাঠাবেন, কিভাবে সংরক্ষণ করবেন তা শিখাতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সংবাদিকদের প্রতিবেদনে সম্পূর্ণ অভিবাসন খাতের তথ্য আনা জরুরি।’
নারী অভিবাসী শ্রমিকের অধিকার বিষয়ক ‘কিনোট পেপার’ উপস্থাপন করেন দৈনিক যুগান্তর এর সাংবাদিক রীতা ভৌমিক।
এতে বলা হয়, বিএমইটি পরিসংখ্যান ডাটা অনুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে ২০২২ এর মে পর্যন্ত ১০ লাখ ৫০ হাজার ৮১৯ জন নারী অভিবাসন করেছেন। এই সংখ্যক নারীর সবাই নির্যাতনের শিকার হয়নি। তার মধ্যে কিছু সংখ্যক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
জানুয়ারি ২০২১-জুন ২০২২ পর্যন্ত সংবাদ মাধ্যমগুলোর খবর পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে সেগুলোতে বেশিরভাগ নেতিবাচক খবরগুলো উত্থাপন করা হয়েছে। বেশির ভাগ খবরগুলো নির্যাতনের শিকার অভিবাসী নারী শ্রমিকদের নিয়ে করা। কিন্তু কীভাবে তারা যাবে, কোন সেবা কেন্দ্র থেকে কী ধরনের তথ্য পাবে, তা মিডিয়াতে কম প্রচার হয়।
প্রথম আলোতে প্রকাশিত হওয়া ১ মে এর প্রতিবেদন মতে, বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের হিসেব মতে, গত তিন বছরে (২০-২২) সন্তান নিয়ে দেশে ফিরেছেন ১২ জন। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফিরেছেন ৬৫ জন নারী। ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর রাতেও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফেরেন এক বাংলাদেশি নারী কর্মী।
মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায় চার দিন বিমানবন্দরে থেকে ২৬ অক্টোবর তাকে উদ্ধার করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি আরবে মারা গেছে তের ও চৌদ্দ বছরের দুই গৃহকর্মী। ২০২১ সালে ১৩ থেকে ২৪ বছরের তিন মেয়ে ও দুই শিশু ভারতের কারাগার থেকে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে দেশে ফিরেছেন। তারা পাচারের শিকার হয়েছিল।
দেশে ফেরত আসা দুজন ভুক্তভোগী নারগিস আক্তার বলেন, জয়পাড়ার মনির নামে এক দালালের (আসল বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া) মাধ্যমে তিনি লেবানন যান। দালাল বিদেশ যাওয়া বাবদ ৫০ হাজার টাকা নেয়। তাকে লেবাননে এক বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ দেয় । সেখানে অনেক অত্যাচার নিযার্তনের শিকার হন তিনি। সব নির্যাতন সহ্য করে ১ বছর কাজ করেন। পরবর্তীতে গৃহকর্তার দ্বারা অত্যাচার ও নিযার্তনের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাওয়ায় সেখান থেকে তিনি পালিয়ে যান। তিনি সেই দেশের ভাষা জানতেন না। এমনকি তার পরিচিতও কেউ ছিলেন না। এক বাঙালি নারীর সহযোগিতায় তিনি একটি কাজ পান। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কোনো কাজও পাননি। বাংলাদেশে তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ থাকায় তিনি দেশেও ফেরত আসতে চাননি। এভাবেই সেখানে কখনো কাজ পেলে কাজ করেছেন, কাজ না পেলে আর্থিক কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন কাটিয়েছেন। এভাবে নারগিস লেবাননে দিনের পর দিন অবস্থান করেন। ২০২০ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশে ফেরত আসেন। দেশে =ফেরার পর তার প্রতিবেশী, পাড়ার লোকেরা তার সাথে কথা বলেনি, অনেকে তাকে নিয়ে কটূক্তি করেছে। তিনি এ ব্যাপারে কোনো মামলা করেননি।
আরেক ভুক্তভোগী মোসা. বেবী আক্তার বলেন, বাড়ির পাশে এক দালালের মাধ্যমে তিনি গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদিতে যান। সৌদি যেতে তার খরচ হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। গৃহকর্তা তাকে খাবার দেয়নি, মারধর করত। ৩ দিন তাকে বাথরুমে আটকে রেখেছিল। একদিন সুযোগ মতো সেখান থেকে পালিয়ে যান। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছিলেন। সেখানে এক বাঙালির সাথে তার দেখা হয়। সেই বাঙালি তাকে বাংলাদেশ দূতাবাসে যাওয়ার পরামর্শ দেন। শুধু তাই নয়, তাকে একটি গাড়িতে উঠিয়ে দূতাবাসে যেতেও সহযোগিতা করেন। তিনি ১৫ দিন দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। কিন্তু দেশে ফিরবেন বিমান ভাড়া নেই। বাংলাদেশ থেকে ২২ হাজার টাকা পাঠালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক ইত্তেফাক, ডেইলি স্টার, দৈনিক সমকাল, নিউ এড, বিজনেস স্ট্যান্ডার্স, অন লাইন এবং টেলিভিশন গণমাধ্যম কর্মীসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মীরা আলোচনায় অংশ নেন।
ইউ