উইমেনআই২৪ প্রতিবেদক: ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ। লাল-সবুজের পতাকার জন্য প্রাণের পাশাপাশি অগুনতি মানুষের জীবন-জীবিকার ত্যাগের গল্পও কম নয়। বিশেষ করে অনেক নারী হারিয়েছেন সন্তান ও স্বজন। নিজেই হাতে তুলে নিয়েছেন অস্ত্র বা নেপথ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের করেছেন সরাসরি সহযোগিতা। মুক্তিযুদ্ধকালে এই নারীদের জীবন সংগ্রাম নিয়েই উইমেনআইয়ের আয়োজন।
১৯৭০ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেন লুলু ই ফেরদৌস। সে সময় ড্যামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং করেন। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে। পাশাপাশি নার্সিং ইনস্টিটিউটে ট্রেনিং করতে থাকেন। ১৯৭১ সালের মার্চে শুরু হয় যুদ্ধ। ২৬ মার্চ কুষ্টিয়া শহর থেকে ৯ ভাইবোনকে নিয়ে পাশের গ্রামে চলে যান। সেখানে ৪ থেকে ৫ দিন অবস্থান করে শহরে ফিরে ভারত সীমান্ত দৌলতপুর উপজেলার ধর্মদহ গ্রামে অবস্থান নেন। সেখানে একদিন থেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের শিকারপুরে চলে যান। এরপর শুরু হয় তাদের পরিবারের আসল যুদ্ধ।
আহত মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের চিকিৎসার জন্য পত্রিকায় নার্স নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। বাংলাদেশে ট্রেনিং নেওয়া থাকায় তাদের বাবা দুই মেয়ের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেন। ছোট বোন লুলু ই জান্নাতেরও নার্সিং ইনস্টিটিউটে ট্রেনিং নেওয়া ছিল। দেশের এ দুঃসময়ে কাজ করতে পারবে ভেবে সহজেই রাজি হন তারা। এরপর তাদের সঙ্গে নিয়ে কলকাতার রাইটার্স ভবনে যান তাদের বাবা সরকারি কর্মকর্তা শুকুর উদ্দিন। সেখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাদের মৌখিক পরীক্ষা নেন। এরপর তাদের দুই বোনকে সীমান্তসংলগ্ন করিমপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়োগ দেওয়া হয় দিন হাজিরায়। দেশ স্বাধীনের আগ পর্যন্ত টানা ৯ মাস দুই বোন মিলে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেন। গুরুতর আহত অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে সেবা দিয়ে যেমন সুস্থ করেছেন, তেমনি আবার চোখের সামনে মারা গেছেন অনেকে। আসার সময় ভারত সরকার থেকে নানা দলিলপত্র হাতে পান। ১৯৮৬ সালে পত্রিকায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা ছাপা হয় তাতে দুই বোনের নামও স্থান পায়। পাশাপাশি সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছেন তারা।
বর্তমানে কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়ার বাসায় একাই বসবাস করেন লুলু ই ফেরদৌস। এক ছেলে এক মেয়ে তার। ছেলে ঢাকায় থাকেন। মেয়ে স্বামীর বাড়িতে। লুলু ই ফেরদৌসের স্বামী, ভাসুরও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এ বাড়িতে বসেই কথা হয় তার সঙ্গে। তুলে ধরেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নানা স্মৃতি।
তিনি জানান, করিমপুরের ছোট একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তারা দুই বোনসহ তিনজন কাজ করতেন। বড় কোনো চিকিৎসক ছিলেন না। এপ্রিলের শেষ দিকে তারা কাজে যোগ দিতেই শুরু হলো কলেরা। প্রতিদিন রোগী আসতে থাকে। এ সময় ভয়াবহ আকার ধারণ করে কলেরা। বিশেষ করে বাংলাদেশি, যারা আশ্রয় নিয়েছেন তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে কলেরা। প্রতিদিন চোখের সামনে ৮ থেকে ১০ জন করে মারা যেতে থাকল। এর মাঝে আহত মুক্তিযোদ্ধারা আসা শুরু করলেন। তখন কাজের চাপ বেড়ে যায়। এর মাঝে বাংলাদেশ থেকে আসা অল্প বয়সী এক তরুণী মা হাসপাতালে ভর্তি হন। কলেরায় তিনি মারা যান। তার শিশুটি তখনও জানে না সে তার মাকে হারিয়েছে। সে মায়ের দুধ পান করতে থাকে। এটা লুলু ই ফেরদৌসকে ভীষণ নাড়া দেয়।
তিনি বলেন, বছরের মাঝামাঝি ও শেষ দিকে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চাপ বাড়তে থাকে। তারা তাঁবু টাঙ্গিয়ে তাতে চিকিৎসা দিতে থাকেন। পরে তাদের কৃষ্ণনগর হাসপাতালে পোস্টিং দেওয়া হয়। সেখানে পরিবেশ বেশ উন্নত ছিল। তাদের সঙ্গে যোগ দেন কুষ্টিয়ার ডা. আলী হোসেন, ডা. হান্নান, ডা. কোরাইশীসহ কয়েকজন।
এরই মাঝে মাথায় গুলি নিয়ে ভর্তি হন এক যুবক। তার অবস্থা বেশ গুরুতর ছিল। তার মাথা দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। পরে তিনি মারা যান। তার নাম ছিল শাহিন। বাড়ি রাজশাহী।
যুদ্ধ চলা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার হালসার এক ব্যক্তি। তার অ্যাপেনডিক্স ছিল। পেটের মধ্যে ফেটে যায়। হাসপাতালে আসার পর বলেন, দুই দিন কিছু খাননি। পরে লুলু ই ফেরদৌস তার খাবার তাকে দিয়ে দেন। লোকটি যে ক'দিন হাসপাতালে ছিলেন হোস্টেল থেকে খাবার এনে দিতেন তিনি। পরে তাকে লুঙ্গি, জামা ও চিরুণিও কিনে দিয়েছিলেন। সুস্থ হয়ে তিনি আবার যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যান। যাওয়ার সময় তিনি লুলু ই ফেরদৌসকে সালাম করতে যান। তিনি বাধা দিলে লোকটি বলেন, 'আপনি আমার মায়ের মতো সেবা দিয়ে সুস্থ করলেন, এ কথা কখনও ভুলব না।'
লুলু ই ফেরদৌস বলেন, ৯ মাসের বেশি সময় শতাধিক আহত মুক্তিযোদ্ধাকে সেবা দিয়েছেন, খাবার দিয়েছেন। তাদের কষ্ট দেখলে মুখে ভাত উঠাতে পারতেন না। সুস্থ হয়ে অনেকেই যুদ্ধে চলে যেতেন। আহতরা ভারতে থেকে যেতেন।
দুই বোন প্রতিদিন বেতন পেতেন ১৬ টাকা। সেই টাকা দিয়ে বাবা-মাসহ ৯ ভাইবোনের সংসার চলতো। তারা ভাড়া বাসায় থাকতেন। দেশ স্বাধীন হলে স্থানীয়রা তাদের বলে, তোমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে। মিষ্টি খাওয়াও আমাদের। তারা দুই বোন খুশিতে কেঁদে ফেলেন।
উইমেনআই২৪.কম//জয়া//