উইমেনআই২৪ডেস্ক : নারীর পরিচয় তুমি নারী, তুমি মমতার ভান্ডারি, তুমি জননী তুমি নারী। নারীরএশাশ্বত রূপআমরা আজীবন ধরেই দেখেছি। নারীওযে রুদ্ররূপ ধারণ করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানে।নিজেরদক্ষতা ও যোগ্যতা দিয়েসমাজে সম্মানজনক অবস্থানে জায়গা করে নিতে পারে তা এখন দেখছে বিশ্ববাসী।
শোননারী তুমি চাইলেই পার সব, চোখ বুঝে কেন; কেন মুখ চেপে আঁচলে, তোমরাই ধরণীর বুকে জলতরঙ্গে সুর তাল লয় এনেছ।তোমরাজগৎকে আলোকিত করো নারী, জ্বলবে আলো জগৎময়। নারীতুমি মূলমন্ত্র ধর, মুখ লুকিয়ে আর নয়।
নারীরএ রূপ সমাজের সব জায়গাতেই এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমনইএকজন সফল নারী রোকসানা পারভীন। মিরপুরবিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যাপক। একাধারেকবি ও সাহিত্যিক।যিনি বালিকাবধূ হয়েও জীবনকে প্রতিষ্ঠা করার পথ থেকে দূরে সরে যাননি। দৃঢ়প্রত্যয়েপড়াশোনা চালিয়ে নিজেকে যোগ্য আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নানাপ্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে সমাজে নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন। ইউমেনআই২৪ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি জীবনের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন। নানাবিষয়ের আলোকে তার জীবনের অজানা কথাগুলো ব্যক্ত করছেন। আলাপচারিতায়উইমেনআই২৪’র পক্ষ থেকেছিলেন আবু সালেহ মো. ইউসুফ। আলাপচারিতারঅংশবিশেষ তুলে ধরা হলো-
উইমেনআই২৪ডটকম : কেমন আছেন আপা?
রোকসানাপারভীন :ভালো।
উইমেনআই২৪ডটকম : আজকে তো বেগম রোকেয়া দিবস। একজননারী হিসেবে এ দিবসটির গুরুত্বআপনার কাছে…..
রোকসানাপারভীন : নারীদের অনেক কথা বলার আছে, অনেক কিছু করার আছে। দেখারআছে জগৎটাকে। কিন্তুনারী এতদিন চোখ বন্ধ করোই ছিল। এতোদিনস্নেহময়ী রূপ ধারণ করে বসিয়ে রাখা হয়েছিল নারীকে। নারীর যে আরো কত রূপ আছে তা দিনে দিনে পৃথিবীবাসী দেখছে। বেগম রোকেয়ার হাত ধরেই বাঙ্গালি নারীর চলার পথ সুগম হয়েছে।
উইমেনআই২৪ডটকম : একজন সফল নারী হিসেবে শুরু থেকেই আপনার পারিবারিক জীবন নিয়ে যদি কিছু বলতেন…
রোকসানাপারভীন : আমি একটি উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করি। আমাদেরবেড়ে উঠাটা খুব চমৎকার ছিলো, খুব বর্ণিল ও স্বপ্নময় ছিল। আমরা৫১ বর্তী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি।আমাদেরপরিবারে আমাদের বাবচাচারা ছয় ভাই ছিলেন। ঈদউৎসবের মতো আমাদের বাড়িতে উৎসব হতো। আজকেআমি দেখি আমরা যেভাবে বেড়ে ওঠেছিলাম আমাদের সন্তানরা বিচ্ছিন্ন বদ্বীপের মতো। সেইআন্তরিকতা নাই, ভোলোবাসার কোন বন্ধন নাই; সেগুলো থেকে তারা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছোটবেলায় প্রজাপতির মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম। আমাদেরশৈশব ছিলো আনন্দময়।
উইমেনআই২৪ডটকম : ৬ ভাই-বোনেরসবাই কী লেখাপড়ারসুযোগ পেয়েছিলেন।
রোকসানাপারভীন : সবাই সুযোগ পেয়েছিল। সবাইআজ প্রতিষ্ঠিত, যার যার নিজ নিজ জায়গায়।
উইমেনআই২৪ডটকম : আপনাদের ভাইবোনের এই প্রতিষ্ঠায় কার অবদানকে আপনি স্মরণ করবেন।
রোকসানাপারভীন : আমারমাকে। মাহচ্ছে সবুজ বৃক্ষ, মা হচ্চে অক্সিজেন; মা ছাড়াতো কোনোভাবে বাচা যায় না।
উইমেনআই২৪ডটকম : এক্ষেত্রে আপনার বাবার কোনো অবদান….
রোকসানাপারভীন : আমি যখন ক্লাশ ফোরে পড়ি তখন আমার বাবা মারা যান। আমারজীবনের গল্পটা বলতে গেলে এখান থেকেই শুরু।
উইমেনআই২৪ডটকম : আচ্ছা..
রোকসানাপারভীন : আমরাকালচারাল একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করি। আমারবাবা ছিলেন পূব পাকিস্তান আমলে মোহামেডান স্পেটিং ক্লাবের সেক্রেটারি। সংস্কৃতিরসঙ্গে আমরা ওতপৌতভাবে জড়িত ছিলাম। আমরাছোটবেলায় আনন্দের বহু মাত্রিকতা দেখেছি।
উইমেনআই২৪ডটকম : মেয়ে হিসেবে খেলাধুলা করা বা সাংস্কৃতিক বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার বিষয়টি আপনার মা কীভাবে দেখতেন…
রোকসানাপারভীন : এমন কোনো বিধিনিষেধ আমাদের সময় ছিলো না। এখনযেরকম ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা দেয়াল তৈরি করে দেয়া হয় বাচ্চা অবস্থাতেই। আমাদেরসময় ছেলে-মেয়ের এমন ধরনের দেয়াল ছিলো না। আমরাভাইবোন একসঙ্গে খেলেছি। একসাথেনানা ধরনের খেলায় মেতেছি। আজকেরছেলেমেয়েরা খেলার দিকে যাবেনা। তারাকোনো খেলা জানেনা, একটা দৌঁড় দিতে জানে না। তাদেরমাঠ নেই যে তারা ছোটাছুটি করে খেলতে পারে। তাদেরমনের আকাশে কোনো আনন্দ নেই।
উইমেনআই২৪ডটকম : তাহলে আপনি ভাগ্যবান এমন একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন..
রোকসানাপারভীন : রবীন্দ্রনাথ বলেছেন আনন্দ ধরা বহিছে ভুবনে আনন্দের ভেলায় চড়ে চড়ে আমাদের দিন কাটতো।
উইমেনআই২৪ডটকম : আপনার শৈশব কেটেছে কোথায়?
রোকসানাপারভীন : আমার শৈশব কেটেছে হাজারীবাগ পার্কের কাছে ২৩ নম্বর বাড্ডানগর লেইনে।
উইমেনআই২৪ডটকম : আপনার পড়াশোনা বিদ্যালয়…
রোকসানাপারভীন : আমি আজিমপুর স্কুলের ছাত্রী ছিলাম। আমিঢাকার প্রথম ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল লিটিল অ্যানজেলস স্কুলে পড়েছি। এটাআজিমপুর কলোনীর ভিতর ছিলো।সেসময়আমি লেবেল টুতে পড়েছি। ওয়ার্ডবুক পড়েছি।
উইমেনআই২৪ডটকম : আপনার খুব কম বয়সে বিয়ে হয়েছিল, তারপরও আপনি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পেরেছেন সমাজে নিজের একটা অবস্থান তৈরি করেছেন। এতেকার অবদান ছিলো।
রোকসানাপারভীন : এখানেআমার মায়ের খুব অবদান ছিলো। আমার১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। তখনআমি বালিকা বধূ। পারিবারিকএকটা অস্থিরতার কারণে এটা হয়েছিল। আরআমার শ্বশুরও আমাদের কিছুটা আত্মীয় হন। তিনিসে সময়তার ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের এমবিবিএস’র মুসলিম ছাত্রছিলেন। আমারশ্বশুরের প্রতিজ্ঞা ছিল তোমার মেয়েটাকে লেখাপড়া শিখিয়ে ওকে আমার মনের মতো করে তৈরি করবো। সত্যিসত্যি তিনি তার কথা রেখেছিলেন। তিনিআমাকে তার মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করেছিলেন। আরসঙ্গে আমার মা ও শাশুড়িরও খুবঅবদান ছিলো। সবসময়তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
উইমেনআই২৪ডটকম : বাবা মারা যাওয়ার পরএতো অল্প বয়সে বিয়ের পাট চুকিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়েছেন। যথাযথভাবেশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। সবভাইবোন প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এটাএকটা বড় ব্যাপার।
রোকসানাপারভীন : আর একটা বিষয় শাশুড়িতোও একজন মা। জীবনেরসফলতার জন্য মায়ের ভূমিকা অনেক বেশি।
উইমেনআই২৪ডটকম : এক নারী আরেকজনের দুঃখটা বুঝে।আপনারশাশুড়ি চেষ্টা করেছেন আপনাকে সেই সুযোগটা দিতে..
রোকসানাপারভীন : নারীরাই পারে নারীদের পথচলা সুগম করতে।
উইমেনআই২৪ডটকম : আপনার বাবা ছোটকালে মারা গিয়েছে তাই হয়তো আপনার মা আপনাকে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যতইবাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বলি না কেন এমন সময় তো আসতেই পারে কারো না কারো জীবনে তাইনা..
রোকসানা পারভীন : ঠিক। জীবনেএমন কিছু ব্যাপারে চলে আসে বাধ্য হয়ে আমাদেরকে তা বরণ করে নিতে হয়। বিয়েহলেই যে একটি মেয়ের জীবন থেমে যেতে হবে এরকম কিন্তু নয়। মনটাআপনার জীবন। যতইপ্রতিবন্ধকতা আসুক তা জয় করতে হবে। জীবনযত চ্যালেঞ্জ হবে সাফল্য তত মধুর ও মজবুত হবে। এইপ্রেরণা মেয়েদের ভেতরে জাগিয়ে দিতে হবে।
উইমেনআই২৪ডটকম : জাতি গঠনেএকজন নারী ও মায়ের ভূমিককী হতে পারে..
রোকসানাপারভীন : একজন নারীকে আমরা কাণ্ডারি বলতে পারি। নিঃসন্দেহেতিনি হবেন শিক্ষিত নারী পরিবারকে সুন্দরভাবে এগিয়ে নেয়ার জন্য, সুশিক্ষিত করার জন্য, মানুষ করার জন্য একজন শিক্ষিত মায়ের বিকল্প নেই।
উইমেনআই২৪ডটকম : বউ যখন লেখাপড়া শিখে বাইরে যায় যে কারণেই যাক না কেন পরিবারের কাজকর্মে কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে কিংবা দেখা না দিলও আশেপাশের মানুষের কথাবার্তা থাকে..
রোকসানাপারভীন : সেটা সামলে দিতেন মা। আরসব যুগেই তা হতে হয়। কেননামায়েরাই পারে আপনাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখতে।
উইমেনআই২৪ডটকম : আপনারস্বামী কি করেন।
রোকসানাপারভীন : তিনিও ভালো মানুষ। তিনিওচাইতেন যে আমি লেখাপড়া করি। সেইসময় উচ্চমাধ্যমিক স্নাতক-স্নাতকোত্তর করেছি। এখনওলেখাপড়া করছি, কখনো তার কাছ থেকে না শব্দটি শুনিনি। আমিপ্রত্যক্ষভাবে ও পরোক্ষভাবে তারকাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি।
উইমেনআই২৪ডটকম : সাংসারিক জীবন পড়াশোনার বিষয়টিকে অনেক কঠোর করে তুলে…
রোকসানাপারভীন : মাঝে মাঝে অনেক কষ্ট লেগেছে। কিন্তুতারপরও আমি মনে করি একজন নারী তার নিজের যোগ্যতায দক্ষতা তার শক্তিতে অকুতোভয় সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই হবে। যতইঢেউ আসুক না কেন তরি বেয়ে যেতে হবে।
উইমেনআই২৪ডটকম : আপনার জীবনের অভিজ্ঞতা জ্ঞান আপনার সন্তান ও ছাত্রছাত্রীদের মাঝে তুলেধরেন…
রোকসানাপারভীন : আমি শুধু আমার তিন ছেলেকে নয়, আমার অগণিত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে জ্ঞানবুদ্ধি ভাগাভাগি করি যাতে তারা সুশৃঙ্খল জীবনচলার পথ খুঁজে পায়। কেননাতারাও আমার সন্তান। আমিযা শেখেছি তাদেরকে সে জ্ঞানটা দিয়েছি। তাদেরকেআলোকিত করতে চেষ্টা করেছি।
উইমেনআই২৪ডটকম : আপা এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। আপনিশিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখি করছেন। এব্যাপারে যদি কিছু বলতেন…
রোকসানাপারভীন : তার আগে বলি আমাদের সময় দারুন একটা ব্যাপার ছিল আর সেটা হলো বই পড়ার প্রতিযোগিতা। আমরাস্কুলে স্কুলে বই পড়তাম লাইব্রেরীতে আমাদের অনেক সময় কেটে যেত। বইপড়তে হলে মেম্বার হতে হতো। বইপড়ার জন্য যে কত মার খেয়েছি। কারণক্লাশের পড়া ফাঁকি দিয়ে গল্পের বই পড়তাম।
উইমেনআই২৪ডটকম : আরও একটি প্রসঙ্গ সামনে এসে গেলো। সেটাহলো আপা এখন কি মনে হচ্ছে না ওই বইগুলি জীবনের জন্য অনেক সহায়ক ছিল…
রোকসানাপারভীন : অনেকভাবে, বই জীবনের অনুভূতিগুলোকে পাল্টে দিয়েছে।
উইমেনআই২৪ডটকম : আপনি কি নিয়ে লিখেন..
রোকসানাপারভীন : আমি কবিতা সাহিত্য চর্চা করি। বিশেষকরে শিশু সাহিত্য নিয়ে লিখছি। আমিগল্প নিয়ে কাজ করছি। যেহেতুআমার বিষয় হচ্ছে বাংলা সাহিত্য সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। সাহিত্যনিয়ে গবেষণা করছি। উপন্যাস-গল্প লিখেছি।
উইমেনআই২৪ডটকম : সামগ্রিক নারী সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার সংগ্রামে আপনার প্রচেষ্টা সফল হোক। আপনাকেধন্যবাদ।
রোকসানাপারভীন : উইমনেআই২৪ ডটকমকেও ধন্যবাদ। সংবাদমাধ্যমে বিশেষ প্লাটফর্ম তৈরি করে নারীদেরকে সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার জন্য।