
সংগৃহীত ছবি
বাংলাদেশে নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে পারিবারিক সহিংসতা, যৌন হয়রানি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণ ও হত্যা চেষ্টার ঘটনা উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, দেশজুড়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোতে অপরাধের শিকার নারী ও শিশুদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতে কর্তৃপক্ষের জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
তা না হলে অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে ও অন্যরা অপরাধ করতে উৎসাহিত হবে। এছাড়াও নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পারলে, নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ প্রবণতা অনেকাংশেই কমে আসবে।
আজ সোমবার (১০ মার্চ) রাজধানীর মিরপুরে এমজেএফ টাওয়ারের আলোক সেন্টারে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) আয়োজিত “নেতৃত্ব ও ক্ষমতায়নের পথে নারীদের অগ্রযাত্রা” – শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এই মন্তব্য করেন।
“অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন নারী ও কন্যার উন্নয়ন” প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২৫ উদযাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয় ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক, রাইটস এন্ড গভার্নেন্স প্রোগ্রামসের বনশ্রী মিত্র নিয়োগী, প্রধান অতিথি ছিলেন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কেয়া খান, বিশেষ অতিথি ছিলেন সুইডিশ দূতাবাসের উন্নয়ন সহযোগিতা বিভাগের প্রধান মারিয়া স্ট্রিডসম্যান৷ কানাডিয়ান হাই কমিশন, বাংলাদেশের সেকেন্ড সেক্রেটারি (ডেভেলপমেন্ট - জেন্ডার ইকুয়ালিটি) স্টেফানি সেন্ট-লরেন্ট ব্রাসার্ড।
শাহীন আনাম বলেন, আমাকে অনেকেই নারী দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েছে ‘হ্যাপি উইমেন্স ডে’ বলে। আজ আমি আসলে হ্যাপি না। সাম্প্রতিক সময়ে নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতার বিষয়ে ইংগিত করে তিনি জানান, আনন্দিত হওয়ার কারণ তিনি দেখছেন না।
আইন উপদেষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন, ১৫ দিনে তদন্ত ও ৯০ দিনের মধ্যে ধর্ষণের বিচার করতে হবে। আমরা পর্যবেক্ষণ করব এই কাথার বস্তবায়ন কতটুকু হয়। ৮ বছর আগে এক শিশুকে ধর্ষণ করার অপরাধে যার শাস্তি হয়, আইনের ফাক ফোঁকর দিয়ে সে বেরিয়ে এসেছে। শাহীন আনাম এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান।
শাহীন আনাম আরও বলেন, হতাশ হলে চলবে না। পরবর্তী প্রজন্ম হাল ধরবে। প্রত্যেক নারীর দায়িত্ব কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সকল অপরাধ রুখে দেওয়া।
অনুষ্ঠানে একটি সংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়।
বনশ্রী মিত্র নিয়োগী বলেন, কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করে আমি নির্যাতনের শিকার কিনা, আমি বলি না। তবে আমি ভয়ে থাকি সবসময়, এই বুঝি কেউ এসিড মারল, কেউ জামা ধরে টান দিল বা কেউ অশ্লীল কথা বলল। শারিরীক ও মানসিকভাবে অত্যাচারিত না হলেও এইযে ভয় পাওয়াটা, এটাও একটা অত্যাচার। এটা সবাইকে অনুধাবন করতে হবে। ভয়হীন সমাজ গড়তে না পারলে নির্যাতন থামবে না।
গভীর শেকড়ের যে পিতৃতন্ত্র ধারক আমাদের সমাজ, সেখান থেকে নারীদের বের হয়ে আসতে হবে। লজ্জা বা ভয় পেয়ে দমে না গিয়ে আওয়াজ উঠাতে হবে।
বনশ্রী মিত্র নিয়োগী তাঁর মূল প্রবন্ধ থেকে বলেন, নেতৃত্বের জায়গায় গার্মেন্টস শ্রমিকরা নিম্ন মজুরিধারী স্বল্প দক্ষতা সম্পন্ন শ্রমিক হিসেবে কর্মরত। এখানে সুযোগ আছে নারীদের দক্ষ করে গড়ে তোলার। এছাড়াও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি প্রশ্ন করে বলেন, আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। রীলসের মাধ্যমে উপস্থাপন হয়েছে বলে মাগুরার সাম্প্রতিক ধর্ষণের ঘটনায় আমাদের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। অথচ ৮ বছর আগের ধর্ষণের আসামী ছাড়া পেয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে, তার কোন প্রতিবাদ নাই কেন? আমাদের গ্রহণযোগ্যতা ও সহ্য করে যাওয়াটা নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ইনফ্লুয়েন্সিং, ক্যাম্পেইন অ্যান্ড কমিউনিকেশনের পরিচালক, নিশাত সুলতানা বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে কথা বলার শক্তি হারিয়ে গেছে, শক্তি সঞ্চার করে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি তাঁর জীবনের গল্প বলতে গিয়ে জানান অনেক বাধা পেরিয়ে নিজে এগিয়ে যাচ্ছি।
মারিয়া স্ট্রিডসম্যান তাঁর লিখিত বক্তব্যে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে নারীদের অগ্রগতি সত্ত্বেও, বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২৪ অনুসারে, ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৯তম, যা দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে থাকলেও অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ, মজুরি সমতা এবং নেতৃত্বের সুযোগে এখনও পিছিয়ে আছে। তিনি যোগ করেন, এমন একটি জেন্ডার-সমতাপূর্ণ সমাজ নিশ্চিত করার জন্য কাজ করতে হবে, যেখানে নারী, বালিকা, পুরুষ এবং বালকেরা সমানভাবে মূল্যবান এবং সমান অধিকার ভোগ করে।
স্টেফানি সেন্ট-লরেন্ট ব্রাসার্ড বলেন, আমরা সত্যিই একটি সমতাপূর্ণ সমাজে বিশ্বাস করি। আমরা অবশ্যই নারীর ক্ষমতায়নে আমাদের প্রচেষ্টাগুলো নবায়ন করব।
কেয়া খান বলেন, নারীদের জন্য সচেতনতামূলক কাজে সব সময় কাজ করে যাচ্ছি আমরা। ৪ হাজার ৫৫৩ ইউনিয়ন ৩৩০ টি পৌরসভায় কিশোর-কিশোরী ক্লাব আছে। আমরা সপ্তাহ ভিত্তিক তাঁদের নিয়ে আলোচনায় বসি। তাঁদের কথা শুনি।
তিনি আরও বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের জন্য আমরা শুধু নারীদের নিয়ে চিন্তা করেছি। এই বিষয়ে পুরুষদের সম্পৃক্ত করে ভাবা হয়নি তেমন একটা। এতে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়েরা। গবেষণার মাধ্যমে ব্যার্থতার জায়গা গুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানটিতে আরও উপস্থিত ছিলেন গণমাধ্যম কর্মী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, তরুণ সমাজ সহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন নারী ও কন্যার সমতা নিশ্চিতকরণ, নারীর নেতৃত্বের পক্ষে সোচ্চার হওয়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ক্ষমতায়িত সমাজ গঠনের জন্য সম্মিলিত উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে।
//এল//