ফাইল ছবি
ফুলের কথা বলতে চাই। বাদল দিনের ফুল। একেকটি বাদল দিনে মন মোর মেঘের সংগী। আর সেই সংগে সঙ্গত হয়ে ধরা দেয় শ্রাবণ ধারায় প্রস্ফুটিত কদমফুল। মৃদু মন্দ গন্ধে মাতানো ঈষৎ পিঙ্গল আর সাদায় সাজানো বলাকৃতির বাদল ধারায় বিকশিত প্রথম কদম ফুল।
কদম আর বর্ষা একে অন্যকে আলিঙ্গন করে বাংলার মাঠ, ঘাট, প্রান্তরে নেমে আসে এক অনাবিল মাদকতা নিয়ে।
কদম তাই বর্ষার প্রথম ফুল। একটি বৃহৎ কদম বৃক্ষ বা নীপবীথি শ্রাবণের নবীন ধারায় স্নাত হয়ে তার নিবিড় ঘন পল্লবিত ডালগুলিতে থরে বিথরে ফুটিয়ে চলে ঈষৎ হলদে সাদার সংমিশ্রণে মনোহরা সুগন্ধি কদম ফুল। চরাচর জুড়ে বয়ে চলা বর্ষার বাতাস তখন কদম সুবাসিত।
এ তো গেল কদমকথা। যাকে আমরা আবহমান কাল ধরে বর্ষার প্রতীক বলে জেনেছি, যেমন জেনেছি আষাঢ়স্য প্রথম দিবস আর তার সাথে বিরহী যক্ষের আকাশে ভাসমান মেঘেদলের প্রতি প্রিয়া মিলনের আকুলতা জানানোর কাব্যিক উপাখ্যান। বাঙালীর বর্ষা যাপনে এ দুটি অনুসঙ্গ তাই কালে কালে হয়ে উঠেছে অপরিহার্য অংশ।
"কিন্তু তুমি নেই বাহিরে- অন্তরে মেঘ করে
ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে! "
বাদল কি কেবলই মানব মনকে বিরহবিধুর করে তোলে? সঘন মেঘের আকাশ দেখে কেবলই কি আঁধারে ভরে যায় মনের চিলেকোঠা? রিমিঝিমি বৃষ্টির ছন্দে মিশে থাকা প্রাণের স্পন্দন! সেও তো বর্ষার অন্য এক রূপ।
শ্রাবণের ধারায় প্রাণ পায় অজস্র ফুলদল। বনে বনে ফুটে থাকে হিজল, তমাল, জলে ভাসে শাপলা, শালুক আরও কত নাম না জানা ফুল। বাগান হেসে ওঠে জুঁই, চামেলি, বেলীর থোকা বাঁধা পুষ্পিতরূপে। ঘোর বরষায় রজনীগন্ধার মাতাল করা সুবাস ব্যতীত জমে না কোন অনুষ্ঠানাদি। শ্রাদ্ধ বাড়ি থেকে বিয়ে বাড়ি সর্বত্র তার অবাধ চলাচল। দোলনচাঁপা তার মোহনীয় রূপ রস গন্ধ দিয়ে তীব্র আশ্লেষে জড়িয়ে রাখে কপোত কপোতীর মনোভুবন।
তপ্ত গ্রীষ্মকে বিদায় জানিয়ে বরষার আগমনে আকাশজুড়ে মেঘের ঘনঘটায় ফুলেরা হয় উন্মনা, অধীর । শ্রাবণের উতল হাওয়া গায়ে মেখে গ্রীষ্মের খরতাপের ক্লান্তি ঝরিয়ে বাদলের ফুলদল হয়ে উঠে নধরকান্তি। যে টুকু যত্নের অভাব তা পুষিয়ে নেয় অবিরাম বারিধারায়।বৃষ্টি কণায় অবগাহন করে এরা হয়ে ওঠে নবীনা সুন্দরী, যেন একেকটি স্বর্গের অপ্সরা! বাগান আলো করে জুঁই, চামেলি, বেলীর সাথে মিলেমিশে ফুটে থাকে
গোলাপী, সাদা হলদে বর্ণের ঘাস ফুল। যাকে ইদানীং রেইন লিলি বলে চিনছি। ফুলেরও বিশ্বায়ন ঘটছে। তাই দেশি ঘাসফুল থেকে ভিনদেশি রেইনলিলির বিবর্তন যেন স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটে গেল।
দিন বদলের সাথে সাথে ফুলেদের নামও পাল্টে যাচ্ছে। এই তো যেমন, বর্ষার আগমনে নতুন করে কুঁড়ি ছড়াতে শুরু করে মাধবী লতা। গোলাপী আভার সাথে সাদার মেলবন্ধনে এক অপরূপ রূপসী। কিন্তু যাকে এতদিন মাধবীলতা বলে জেনেছি, তিনি আদতে মাধবীলতা নন। বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে এর প্রকৃত নাম নিয়ে। বর্তমানে এই ফুলটি মাধবীলতা নামের পরিবর্তে মধুমন্জরী নামেই পরিচিতি পাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি এই নামকরণ করে গেছেন। তাহলে কে মাধবীলতা? রবীন্দ্রনাথই তার গানের বাণীতে জানিয়ে গেলেন, "মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এল, ফাগুন দিনের স্রোতে"। তবে কি মাধবী নামের ফুলটি বসন্তে ফোটে? থাক তবে মাধবী বৃত্তান্ত। বরং মধুমন্জরী বা আর সব বর্ষার ফুলের গল্পে ফিরে আসি।
মেঘমেদুর বাদল দিনের শেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই বাগান যেন মধু গন্ধে ভরা। ঘন মেঘের সাঁঝবেলায় উল্লসিত শ্বেতশুভ্র দোলনচাঁপা, বা নাগচাঁপারা। এরা তখন পূর্ণ যুবতী। সলজ্জ ভঙ্গীতে একে একে মেলে ধরে তাদের অনিন্দ্য সুন্দর পাপড়িদল। একই সাথে ছড়িয়ে দেয় বাগানময় মিষ্টি সুবাস। আষাঢ়ের ফুলদল হয় কোনটা তীব্র কোনটা বা মৃদু সৌরভময়। জল ছলছল বৃষ্টি কণার পরশ পেয়ে তাদের যেমন রূপমাধুরী উপচে পড়ে তেমনি সুবাসিত করে ঘরদোর, উঠান, বারান্দা। তবে অধিকাংশ বর্ষার ফুল রংহীন। শ্বেতশুভ্র পুষ্পদামের খাঁজে খাঁজে যেন বিরহী রাধার সকরুণ বৈধব্য রূপ।
ইদানীং ফ্ল্যাট বাড়ির ছোট বারান্দায় অনেকেই চাষ করছেন নানাজাতের বর্ষার ফুল। টগর, জবা,বেলী, কাঠগোলাপ আর কামিনীর সুবাস বেশ ঘরে বসেই উপভোগ করা যায়। এ যেন নগরজীবনের নানা ভোগান্তি ভুলিয়ে দিতে এক বিশল্যকরণী।
ঐ মালতীলতা দোলে
বাংলা গদ্যে, কবিতায় মালতী নামের আরও একটি বর্ষাকালীন ফুলের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে লক্ষ্য করা যায়। অনেকটা শিউলিফুলের আকৃতির লতানো বৃক্ষের সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়ে যায় মালতীফুল। সুরভিত ফুলেল পরিবারের আরেকটি অনিবার্য সদস্য। অবিরাম বৃষ্টির ছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে দোদুল দুলে যায় মালতীলতা। এর মিষ্টি সুবাস অনেক নাম না জানা পথিককেও আপন ভোলা করে তোলে। তবে মালতীলতার বাস্তব উপস্থিতি অনেকটাই সীমিত। কথায় বলে, মালতী আছে গানে আর বনে।
আষাঢ়, শ্রাবণ আসে যায় প্রকৃতির নিয়মে। সাথে করে নিয়ে আসে বকুলের মিষ্টি সুরভী। প্রিয়ার খোঁপায় বকুল ফুলের মালা জড়িয়ে দেবার স্বপ্নে বিভোর প্রেমিকের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়।
বকুল ফুলের মিঠে ঘ্রাণে একেকটি মাতাল মন আবারও একটি বর্ষার অপেক্ষায় দিন গুনে যায়।
"কেতকি কদম যূথিকা কুসুমে বর্ষায় গাঁথ মালিকা
পথে অবিরল ছিটাইয়া জল খেলে চঞ্চলা বালিকা"
অথবা,
" রিমিঝিম রিমিঝিম ঐ নামিল দেয়া
শুনি শিহরে কদম, বিদরে কেয়া, "
কবি নজরুলের বাণীতে ইতি টানতে গিয়েই মনে পড়ল বর্ষার আরেকটি উল্লেখযোগ্য ফুল কেতকি বা কেয়া।
কেয়া বিনে বর্ষা কেমন যেন পানসে মনে হয়। এই অবরুদ্ধ নগর জীবনে আষাঢ় এলেই কাদা প্যাচপেচে পথ ঘাট আর জলাবদ্ধতায় যেখানে নগরবাসী নাকাল, তেমন পরিস্থিতিতে কেয়া ফুলকে স্মরণে আনা যায় মাত্র। কিন্তু তার দেখা মেলা ভার। কেয়া ফোটাতে চাইলেই ফোটে না। এর চাহিদা কিঞ্চিৎ বেশি। কেয়া বা কেতকী ঘন বন সাদৃশ্য ঝোপঝাড় পছন্দ করে। কেয়ার বৃদ্ধি এবং প্রস্ফুটিত হবার জন্য এমন বাতাবরণ নগর জীবনের ক্ষুদ্র পরিসরে প্রায় অসম্ভব। সাধারণত সমুদ্র বা নদীতীরবর্তী নোনাজল ঘেঁষে গজিয়ে ওঠে কেয়ার ঝোপ। আর বরষার নবীন জলে কেয়া যেন নওল কিশোরী। বাদলের আর সব ফুলের মতই কেয়াও তার দৈহিক সৌন্দর্যের সাথে সাথে মিষ্টি সৌরভে মাতিয়ে তোলে ভরা বাদর।
আটপৌরে বাঙালী জীবনে বর্ষা বিলাস খিচুরি, ইলিশ অথবা মেঘমল্লারের গন্ডি পেড়িয়ে জুঁই, চামেলি, কেয়া, কদমের ফুলেল উপস্থিতিতে ভরে থাকে। ভরে থাকে বকুল কথায়। ছোট এই জীবনের ছোট ছোট চাওয়াগুলো পরিপূর্ণ রূপ পায় বাদল হাওয়ায় আন্দোলিত মালতীলতা বা মধুমন্জরীর বিকশিত রূপ-মাধুর্যে। ফুল্ল হয় শ্রাবণ দিনের এক একটি পল অনুপল। আকাশজুড়ে রচিত হয় মেঘমায়ালোক, তার সাথে বৃষ্টিস্নাত বসুন্ধরা সেজে ওঠে কুসুমিত পত্র পল্লবে।
ইউ